""

সন্তু লারমা কেন ইউপিডিএফ-কে ধ্বংস করতে চান?


মিল্টন চাকমা, সংগঠক, ইউপিডিএফ, দীঘিনালা ইউনিট

গত ২৫ বছর ধরে ইউপিডিএফ পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িক হামলা, ভূমি বেদখল ও নারী নির্যাতনসহ জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলন চালিয়ে আসছে। যেখানেই জনগণের ওপর অন্যায় অত্যাচার হয়েছে, সেখানেই ইউপিডিএফ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে আর অন্য কোন পার্টি বা সংগঠন ইউপিডিএফের মতো এভাবে আন্দোলন সংগঠিত করেনি এবং এখনও করছে না। ইউপিডিএফের প্রতিরোধ সংগ্রামের কারণে অনেক জায়গায় ভূমি বেদখল রোধ করা সম্ভব হয়েছে এবং পাহাড়ি নারীদের ওপর যৌন সহিংসতার মাত্রা কিছুটা হলেও কমেছে।

তবে এই আন্দোলনের জন্য ইউপিডিএফ-কে কম মূল্য দিতে হয়নি। পার্টির অনেক নেতাকর্মীকে বিচার-বহির্ভুত হত্যা, গুম, গ্রেফতার, জেল-জুলুম, হামলা-মামলা ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। এখনও পার্টির ওপর সরকারের নিষ্ঠুর দমনপীড়ন অব্যাহত আছে।

কেন সরকার ও সেনাবাহিনী ইউপিডিএফের ওপর দমনপীড়ন চালায়? সরকার-সেনাবাহিনী ইউপিডিএফ-কে ধ্বংস করতে চায়, কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামে একমাত্র ইউপিডিএফ-ই জনগণের স্বার্থের অতন্দ্র প্রহরীর মতো তার জাতীয় দায়িত্ব পালন করে চলেছে। ফলে শাসকগোষ্ঠী ইচ্ছামত জনগণের সম্পদ, ভূমি লুণ্ঠন করতে পারছে না, বিনা বাধায় পাহাড়ি জাতিগুলোর জাতীয় অস্তিত্ব বিলুপ্ত করে দেয়ার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে পারছে না। এ কারণে সেনা-শাসকগোষ্ঠী যে জনগণের স্বার্থের পাহারাদার ইউপিডিএফ-কে ধ্বংস কিংবা দুর্বল করতে চাইবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেনা-শাসকগোষ্ঠীর মতো জেএসএসের এক অংশের সভাপতি সন্তু লারমা কেন ইউপিডিএফ-কে নির্মূল করতে চান? যে পার্টি জনগণের পক্ষে কাজ করছে, যে পার্টির নেতাকর্মীরা জুম্ম জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে অকাতরে জীবন দিচ্ছে, সেই পার্টিকে কেন সন্তু লারমা ধ্বংস করতে গত ২৫ বছর ধরে উঠেপড়ে লেগেছেন? জনগণের মধ্যে এটি একটি বড় প্রশ্ন, যার উত্তর সন্তু লারমা কিংবা অন্য কোন জেএসএস নেতা এখনও দেননি।

সন্তু লারমা। সংগৃহিত ছবি

স্বাভাবিকভাবে দেখলে ইউপিডিএফের নেতৃত্বে যে আন্দোলন চলে আসছে তাতে সাধারণ জনগণের মতো জেএসএসেরও খুশী হওয়ার কথা। কিন্তু রাজনীতিতে সব সময় দুই-এ দুই-এ চার হয় না। অর্থা জনগণের স্বাভাবিক প্রত্যাশা মতো রাজনীতি চলে না। কারণ এখানে এমন পক্ষ থাকে, এমন স্বার্থবাজ থাকে, যারা দুই-এ দুই-এ চার হতে দেয় না। বলতে দ্বিধা নেই, সন্তু লারমা হলেন এই ‘হতে না দেয়াদের’ একজন।

ইউপিডিএফ-কে নির্মূল করতে চাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি প্রথমদিকে বলতেন, ইউপিডিএফ হলো ডিজিএফআই-এর সৃষ্টি। কিন্তু সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের প্রশ্ন হলো, ইউপিডিএফ ডিজিএফআইয়ের সৃষ্টি হলে, সেনাবাহিনী, ডিজিএফআই ও পুলিশ কেন ইউপিডিএফের নেতাকর্মীদের ধরে ধরে মেরে ফেলবে, গ্রেফতার করবে ও নির্যাতন চালাবে? কেন তাদের সমাবেশ ভণ্ডুল করে দেবে?

সন্তু লারমা আরও বলতেন, ইউপিডিএফ-ই তাদের ওপর আগে আক্রমণ করেছে, তাই তারা প্রতিরোধ করতে বাধ্য হচ্ছে। তার এই মিথ্যা ও মতলববাজী প্রচারও হালে পানি পায়নি। কারণ কে আগে আক্রমণ করেছে, কে বার বার সমঝোতার পরও তা লঙ্ঘন করেছে এবং কে সংঘাত জিইয়ে রাখতে চায়, তা সবার জানা হয়ে গেছে।

বস্তুত: ইউপিডিএফ গঠনের অনেক আগেই সন্তু লারমা ইউপিডিএফ নেতাদের (তখন পাহাড়ি গণ পরিষদ ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতা) ওপর আঘাত হানতে শুরু করেছিলেন। চুক্তি স্বাক্ষরের কয়েক মাস আগে, ১৯৯৭ সালের ৫ আগস্ট পানছড়ির লতিবান থেকে সন্তু লারমার লোকজন পিসিপির তকালীন কেন্দ্রীয় সদস্য অনিমেষ চাকমা রিংকু ও পিসিপি পানছড়ি থানা শাখার প্রাক্তন সভাপতি কুসুমপ্রিয় চাকমাকে অপহরণ করে। পরে জনগণ সংঘবদ্ধ হয়ে তাদের মুক্ত করে। পার্বত্য চুক্তির পর এই আঘাতের মাত্রা শতগুণ বেড়ে যায়। ১৯৯৮ সালের ৪ এপ্রিল পানছড়িতে প্রদীপ লাল চাকমা ও কুসুমপ্রিয় চাকমাকে খুন করা হয়।

সন্তু বাবুর আরও একটি অপপ্রচারণা ছিল: ইউপিডিএফ চুক্তি বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করছে। কিন্তু সেটাও যে মিথ্যা ও সন্তু লারমা নিজেই যে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলনে যেতে চান না, সেটাও স্পষ্ট হতে বেশী দিন সময় লাগে নি। ইউপিডিএফ চুক্তির সমালোচনা করলেও তার বাস্তবায়নের পথে কখনও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বরং ইউপিডিএফ চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে জেএসএসকে সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু সন্তু লারমা ইউপিডিএফের সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। আসলে সন্তু বাবু কেবল ইউপিডিএফ-কেই নির্মূল করতে চান; চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন করতে তার কোন ইচ্ছা নেই।

কিন্তু কেন সন্তু লারমা ইউপিডিএফের সহযোগিতার প্রস্তাব সত্বেও চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন করতে চান না? এর উত্তর খুবই সহজ। তিনি আন্দোলন করতে চান না আঞ্চলিক পরিষদের গদি হারানোর ভয়ে। জনগণের অধিকারের চাইতে, জনগণের স্বার্থের চাইতে আঞ্চলিক পরিষদ তার কাছে বড়। জাতীয় স্বার্থ ক্ষতি করে হলেও তিনি ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকতে চান। (আসলে আঞ্চলিক পরিষদে আর্থিক ও ব্যক্তিগত অন্যান্য কিছু সুবিধা ছাড়া কোন ক্ষমতা নেই।) সন্তু লারমা তার কর্মী বাহিনীকে বোঝাতে চান যে, তিনি যদি আঞ্চলিক পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন তাহলে আঞ্চলিক পরিষদ দালালদের হাতে চলে যাবে। (যেন তিনি দালাল নন!) হাস্যকর যুক্তি!! নিজের ক্ষমতালিপ্সা ও সুবিধাবাদকে জায়েজ করার জন্য সন্তু লারমার এ এক অকাট্য যুক্তি!

গত ২৫ বছরে ধরে সন্তু লারমা আঞ্চলিক পরিষদে বসে জুম্ম স্বার্থের বিরুদ্ধে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত চালিয়ে যাচ্ছেন এবং সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন না করে সেনাবাহিনীর নির্দেশমত নিজের জাত-ভাইয়ের বুক ঝাঁঝরা করে দিচ্ছেন, ইউপিডিএফের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের প্রাণনাশ করে চলেছেন।

দু’টি কারণে তিনি ইউপিডিএফ-কে নির্মূল করতে চান। এক নিজের সুবিধাবাদীতা, বিশ্বাসঘাতকতা, ক্ষমতালিপ্সা ও দালালবৃত্তিকে আড়াল করা। যেহেতু সন্তু বাবু সরকারের বিরুদ্ধে নিজে আন্দোলন করেন না, তাই তিনি চান না অন্য কোন দল আন্দোলন করুক। কারণ অন্য কেউ আন্দোলন করলে তাতে তার সুবিধাবাদীতা ও দালালীর চরিত্র উন্মোচিত হয়ে যায়। তাই তিনি নানা কৌশলে ইউপিডিএফের আন্দোলনে ব্যাঘাত ঘটিয়ে চলেছেন।

ইউপিডিএফ-কে নির্মূল করতে চাওয়ার অন্য কারণটি হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনীতিতে তার নিজের একাধিপত্য বজায় রাখা। এ হলো তার চরম ফ্যাসিস্ট মানসিকতা। তার তত্ব হলো এক বনে দুই বাঘা থাকতে পারে না। অর্থা ইউপিডিএফ থাকতে পারবে না।

এটা আজ সবার কাছে পরিস্কার যে, সন্তু লারমা যদি গত ২৫-২৬ বছর ধরে ইউপিডিএফ-কে ধ্বংস করার নীতি গ্রহণ না করে চুক্তি বাস্তবায়নের দিকে মনোযোগ দিতেন, জনগণের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতেন, তাহলে আজ পাহাড়ের চিত্র ভিন্ন হতো। যে শত শত প্রতিশ্রুতিশীল জুম্ম তরুণ তার এই নীতির কারণে প্রাণ হারালেন, তারা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনে ভূমিকা রাখতে পারতেন। সরকার চুক্তি বাস্তবায়নসহ জনগণের অধিকার কায়েম করতে বাধ্য হতো।

সন্তু লারমার ইউপিডিএফ নির্মূলের প্রাণপণ চেষ্টা সত্বেও, গত ২৫ বছরে ইউপিডিএফতো নির্মূল হয়নি, বরং তার শক্তি উত্তরোত্তর বেড়েছে। অন্যদিকে এই সময়ে জেএসএস দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে অনেক দুর্বল হয়ে গেছে। কাজেই জেএসএসের মধ্যে যারা এখনও জনগণের স্বার্থের কথা ভাবেন, জাতীয় অস্তিত্ব নিয়ে উদ্বিগ্ন হন, তাদের উচিত সন্তু লারমার জাতীয় স্বার্থ বিরোধী নীতি, কর্মসূচি ও কার্যক্রমের ওপর বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা করা। সন্তু লারমার কাছে বা নিজেদের কাছে তাদের এই প্রশ্নগুলো করা উচিত: ১) ইউপিডিএফ-কে নির্মূল করা কী আদৌ সম্ভব? যে পার্টিকে গত ২৫ বছর ধরে অনেক চেষ্টা করেও নির্মূল করা যায়নি, (যদিও তখন তার শক্তি এখনকার তুলনায় অনেক কম ছিল ও জেএসএসের শক্তি বহুগুণ ছিল) সেই পার্টিকে আদৌ ধ্বংস করা সম্ভব কী? ২) আর ইউপিডিএফ-কে কেন-ই-বা নির্মূল করতে হবে? কী তার অপরাধ? ইউপিডিএফ নেতারা কী সরকারের দালালি করছেন, না নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধার করছেন? (তারাতো এসবের মধ্যে নেই। তারাতো আন্তরিকভাবে জনগণের স্বার্থে দিনরাত কাজ করে চলেছেন।) ৩) ইউপিডিএফ-কে নির্মূল করা হলে তাতে কার লাভ? এতে কী জনগণের লাভ? নাকি সরকার, সেনাবাহিনী ও জুম্ম জনগণের শত্রুদের লাভ? ৪) ইউপিডিএফ না থাকলে ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে, পাহাড়ি নারীদের ওপর সেনা সেটলারদের যৌন আক্রমণের বিরুদ্ধে, পাহাড়ি গ্রামে সেনা-সেটলার হামলার বিরুদ্ধে কারা প্রতিরোধ ও সংগ্রাম করবে? হয়তো কেউ কেউ বলতে পারেন, জেএসএস আন্দোলন করবে। কিন্তু যদি তারা মনে করেন ইউপিডিএফের অবর্তমানে জেএসএস আন্দোলন করবে, তাহলে বলবো তারা বাস্তবতা জানেন না। ইউপিডিএফ জন্ম হওয়ার আগেও জেএসএস ছিল, পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের একক আধিপত্য ছিল। কিন্তু তখন তো তারা আন্দোলন করেনি, বরং সারেন্ডার করেছে। তাছাড়া ভূমি বেদখল-বিরোধী আন্দোলনের কোন অভিজ্ঞতা জেএসএস নেতাদের নেই। তারা এখন সবাই বিদেশে সুখে বসবাস করছেন। সেখান থেকে এসে তারা আন্দোলন করবেন, তা কেউ বিশ্বাস করে না।

যাই হোক, উপরের চারটি প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর না পেলে জেএসএস নেতাকর্মীদের কখনোই উচিত হবে না কেবল সন্তু লারমা ও তার জামাই বাবুদের কথায় নিজের জাত ভাই তথা ইউপিডিএফের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ওপর হামলা-খুন করা। তাদের প্রতি পরামর্শ আপনাদের সাংগঠনিক শক্তিকে জনগণের পক্ষে নিয়োজিত করুন, আন্দোলনের কাজে লাগান। সংঘাতের পথ ছেড়ে ঐক্যের পথে আসুন।# 

(১৮ জুন ২০২৪)

* লেখাটি ইউপিডিএফের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া।



সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।







0/Post a Comment/Comments