""

জুরাছড়িতে সেনা কমাণ্ডারকে ‌‘সালাম’ না দেয়ায় পুলিশকে মারধর, থানায় লঙ্কাকাণ্ড!

সেনাবাহিনীর মারধরে আহত দুই পুলিশ সদস্য

রাঙামাটি প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ

বুধবার, ২৮ আগস্ট ২০২৪

রাঙামাটির জুরাছড়ি উপজেলা সদরের যক্ষাবাজার এলাকায় সেনাবাহিনীর বনযোগীছড়া অদ্বিতীয় ২ জোন কমণ্ডার লে. কর্ণেল জুলকিফলী আরমান বিখ্যাত-কে সালাম না দেয়ায় সেনা সদস্যদের মারধরের শিকার হয়েছেন থানার ওসি সহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য, থানায় চালানো হয়েছে হামলা-ভাঙচুর, তছনছ করে দেয়া হয়েছে জিনিসপত্র, পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে মোটর সাইকেল।

সেনাবাহিনী কর্তৃক স্থানীয় লোকজনকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে ও থানা আক্রমণ করতে বাধ্য করা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

গতকাল মঙ্গলবার (২৭ আগস্ট ২০২৪) বিকাল সাড়ে ৫টায় ঘটনার সূত্রপাত হয়। রাত পর্যন্ত চলে তাণ্ডব।

এ ঘটনায় পুলিশ ও স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে ঘটনা বিষয়ে যতটুকু জেনেছেন তা তুলে ধরার চেষ্টা করেন। বেতার/ই-মেইল বার্তা পাঠিয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ঘটনা অবহিত করে পুলিশ।

ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে

ঘটনাটি নিয়ে রাঙামাটি জেলা পুলিশের ওসি পুলিশ বেতার মো. মুরিদুল ইসলাম এর পুলিশের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে পাঠানো এক বেতার/ই-মেইল বার্তা পাওয়া যায়। এতে ঘটনার সূত্রপাত জানিয়ে বলা হয়, “রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাধীন জুরাছড়ি থানায় অদ্য ২৭ / ০৮ / ২০২৪ খ্রি. অনুমানিক ১৭.৩০ ঘটিকায় জুরাছড়ি থানায় কর্মরত ০৩ জন চাকমা কনস্টেবল থানার পার্শ্ববর্তী যক্ষা বাজারে চা পান করতে যায়। ওখানে আর্মির সিও স্যার উনার পরিবার সহ ছিল। কিন্তু উক্ত কনস্টেবল গণ সালাম না দেওয়ায় মারধর এর শিকার হয় এবং ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। তাক্ষণিকভাবে জুরাছড়ি থানার ওসি পুলিশ সুপার মহোদয়কে জানালে, স্যার ক্যাম্পে যেতে বলে। ওসি সংগীয় অফিসার সহ ক্যাম্পের ভিতর যেতে চাইলে ক্যাম্পের সামনে আটকে দেয় এবং ওসি সহ সবাইকে মারতে শুরু করে এবং ওইখান থেকে তারা পালিয়ে যায়। থানায় টেলিকম এর অপারেটর নাই, জেলার পুলিশ এর একজন অপারেটর আছেন। তার সাথে যোগাযোগ করে জানা যায় সকল পুলিশ সদস্য নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে। সেনাবহিনী এবং স্থানীয় জনগণ মিলে থানা এলাকা ঘেরাও করে থানার সামনে আগুন জ্বালিয়ে দেয়, একথা বলার পর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। পরবর্তীতে আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। রাঙ্গামাটি জেলার পুলিশ সুপার সংগীয় অফিসার ফোর্সসহ জুরাছড়ি থানার উদ্দেশ্যে রওনা করেন। ঘটনার বিস্তারিত পরবর্তীতে জানার পর জানানো হবে”।

ঘটনা জানিয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে পাঠানো রাঙামাটি পুলিশের বেতার বার্তা/ই-মেইল

নিজেকে এসআই রিয়াদ পরিচয় দিয়ে একজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে আতঙ্কজনক অবস্থায় লেখেন, “আমি এসআই রিয়াদ জুরাছড়ি থানা, রাঙ্গামাটি থেকে। আজ বিকালে আমাদের থানার ০৩ জন চাকমা কনস্টেবল থানার পাশে যক্ষ্মাবাজারে চা পান করতে যায়। ওখানে আর্মির সিও স্যার উনার পরিবার সহ ছিলো কিন্ত কনস্টেবলরা সালাম না দেওয়ায় ওদের অনেক মারছে এবং হাটুর কাছে ৩টা ফায়ার করছে এবং ধরে ক্যাম্পে নিয়ে গেছে। ওসি সহ আমরা সবাই ঘটনা এসপি স্যারকে জানালে স্যার ক্যাম্পে যেতে বলে। আমরা যেতে চাইলে ক্যাম্পের সামনে আটকে দেয় এবং ওসি সহ সবাইকে মারতে শুরু করে। আমি কোন রকমে একটা ঘরে আশ্রয় নিছি। ওসি সহ বাকিরা কই গেছে জানিনা। খুব ভয়ে আছি কখন এসে ধরে নিয়ে যায় আর কি করে। ভাই সবাই একটু দোয়া করিস। পুলিশ ভাইরা আপনারা এই বিষয়টি এখনি শেয়ার করেন।যাতে উর্দ্ধোতন কতৃপক্ষের চোখে পড়ে।”

আহত পুলিশ সদস্য

পূর্ন বর্ধন নামের ফেসবুক আইডি থেকে ঘটনা সম্পর্কে লেখা হয়, “পুরো ঘটনাটা হচ্ছে রাঙামাটির জেলার জুরাছড়ি উপজেলায় ১নং ইউনিয়নে আজকে। সেনাবাহিনীর কমান্ডার যক্ষা বাজারে গেলে সেখানে তাকে পুলিশ সদস্যরা সালাম দেয়নি, এক পর্যায় সেই কমান্ডার এক পুলিশের গালে থাপ্পর দেয়। তারপর সেই পুলিশ সদস্যরাও কমান্ডারকে মারে। তারপর সেনাবাহিনী জনগণের ঘরে ঘরে গিয়ে সাধারণ জনগণকে আন্দোলন করার জন্য ঘরে ঘরে দরজায় বাড়ি মারে। কিছু সংখ্যক লোককে তারা ধরে নিয়ে যায় এবং জুরাছড়ি থানায় আগুন দিয়ে দেয়। যারা আন্দোলনে যায়নি তাদের সেনাবাহিনী ধরে নিয়ে যাবে বলে এক সেনা সদস্য হুশিয়ারি দিয়ে গেছে। এখন কথা হচ্ছে তাদের এই ঝামেলা সাধারণ জনগণকে কেন হয়রানির শিকার হতে হবে?”

সেনা সদস্যরা এক পুলিশ সদস্যসে পেটাচ্ছে। 

সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে আরেকজন ঘটনাটি নিয়ে লেখেন, ‍“আজ বিকেলে রাঙামাটি জেলার জুরাছড়ি উপজেলার বনযোগীছড়া সেনা জোনের জোন কমান্ডার জুলফিকলি [জুলকিফলী] আরমান বিখ্যাত তার দুই সৈনিক নিয়ে সাদা পোশাকে উপজেলা সদরে ইভিনিং ওয়াকে (হাঁটতে) বেরিয়েছেন।
পথে দোকানের পাশে বসে চা খাচ্ছিলেন সাদা পোশাকে তিন চাকমা পুলিশ সদস্য। তারা জোন কমান্ডারকে সালাম দেননি এই অভিযোগে জোন কমান্ডারের সঙ্গী দুই সেনা সদস্য তিন চাকমা পুলিশ চর-থাপ্পর মারেন। এতে চাকমা পুলিশরাও দুই সেনার সাথে হাতাহাতি করেন। এরপর জোন কমান্ডার ও দুই সেনা সদস্য ক্যাম্পে ফিরে যান। পুলিশ সদস্যরা থানায় ফিরে যান।
এর কিছুক্ষণ পর জোন কমান্ডার এর নেতৃত্বে একদল সেনা সদস্য থানায় উপস্থিত হন এবং কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে থানা ভিতরে প্রবেশ করে তিন চাকমা পুলিশ সদস্যকে লাঠ-ঘুষি দিয়ে ব্যাপক মারধর করেন। সেনা সদস্যরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)-কেও ব্যাপক মারধর করেন। এরপর মেরে মেরে সেনা সদস্যরা চাকমা পুলিশদের বেঁধে বনযোগীছড়া জোনে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখেন। জানা গেছে, প্রহৃত পুলিশদের হাত/পাও ভেঙে দেওয়া হয়েছে।

সেনা সদস্যদের মারধরে আহত হয়ে চিকিৎসাধীন এক পুলিশ সদস্যরা। ছবি জুরাছড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে তোলা 

ঘটনা সেখানেই থেমে থাকেনি। জানা গেছে, সেনা সদস্যরা একদিকে বাজারে একদল দোকানদারকে দিয়ে থানা ও পুলিশের দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ তুলে, শ্লোগান দিয়ে মিছিল করতে বাধ্য করে, অপরদিকে সেনা সদস্যরা নিজেরাই থানায় অগ্নিসংযোগ করে উত্তেজিত জনতা অগ্নিসংযোগ করেছে বলে প্রচার করছে। এই নিয়ে এলাকায় জনগণের মধ্যে গভীর উদ্বেগ ও আতঙ্ক বিরাজ করছে বলে জানা গেছে।
ঘটনাটি ইতিমধ্যে উপর মহলে গেছে বলে জানা গেছে। সতর্ক থাকুন। আতঙ্ক নয়। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাও নয়।আশাকরি, সরকার বা উর্ধতন কর্তৃপক্ষ দ্রুত নিরপেক্ষ তদন্ত করে যথাযথ বিচার বা সমাধানের ব্যবস্থা করবেন। দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা করবেন। ঘটনাটি দুঃখজনক। ন্যাক্কারজনক এবং লজ্জাজনক।”

ঘটনায় আহত থানা অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আব্দুস সালামসহ পুলিশ সদস্যদের জুরাছড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।

ঘটনার পর রাতে রাঙামাটি পুলিশ সুপার মীর আবু তৌহিদ ঘটনাস্থলে যান। তিনি আহতদের দেখতে ছুটে যান জুরাছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।

এ ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে আইনগত কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কিনা তা জানা যায়নি।

 


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।


 





0/Post a Comment/Comments