""

সাজেকের অশান্ত পরিস্থিতি ও নাঈম হত্যা প্রসঙ্গে


অমৃত লাল চাকমা, বাঘাইছড়ি, ২২ জুন ২০২৪

ভারতের মিজোরাম সীমান্তবর্তী রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক পর্যটন গন্তব্য হিসেবে অনেকের কাছে বেশ পরিচিত। কিন্তু সাজেক কেবল পর্যটকদের আকর্ষণের জায়গা নয়, অন্য অনেক কারণে এলাকাটি সংবাদ মাধ্যমের দৃষ্টিও আকর্ষণ করে থাকে।

২০০৮ ও ২০১০ সালে এখানে পাহাড়ি বসতিতে বড় ধরনের হামলা চালিয়ে শত শত ঘরবাড়ি আগুনে পুড়ে ছাই করে দেয়া হয়। সে সময় বুদ্ধপুদি চাকমাসহ চার জন নিহত হন এবং শত শত পাহাড়ি পরিবার তাদের সর্বস্ব হারায়। মূলতঃ পাহাড়িদের উচ্ছেদ করে সেখানে বাঙালিদের বসতিস্থাপনের জন্য এইসব হামলা চালানো হয়েছিল। বাঘাইহাট জোন এই হামলার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল।

২০১০ সালের পর থেকে সাজেকের পরিস্থিতি মোটামুটি শান্ত থাকে। কিন্তু গত ৯ জুনের নির্বাচনে অবৈধ প্রভাব খাটানোর জন্য ৭ জুন ঠ্যাঙাড়ে সন্ত্রাসীদের নিয়ে আসা হলে সাজেকের পরিস্থিতি আবার অশান্ত হয়ে ওঠে। ঠ্যাঙাড়েরা বাঘাইহাট সেনা জোনের পাশে বাজারে রাঙ্গুনীয়া বোর্ডিং-এ অস্ত্রসহ প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়ে লোকজনের ওপর অত্যাচার, হয়রানি ও জুলুম শুরু করে দেয়। তাদের কারণে এলাকার জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও ব্যবসা-বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হয়। বিশেষ একজন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীর পক্ষ হয়ে তারা নির্বাচনী এজেন্ট, পোলিং এজেন্ট ও সাধারণ ভোটারদের হুমকি দিলে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট হয়ে যায়। এ অবস্থায় ঠ্যাঙাড়েদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে সড়ক ও নৌপথ অবরোধ করা হলে নির্বাচন স্থগিতের ঘোষণা দেয়া হয়। প্রশাসন সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য ঠ্যাঙাড়েদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে কেন শেষ মুহূর্তে নির্বাচন স্থগিত করেছে তা এক বড় প্রশ্ন।

যাই হোক, সেনা ক্যাম্পের একেবারে নাকের ডগায় অস্ত্রধারী ঠ্যাঙাড়ে সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে ও দোর্দণ্ড প্রতাপে ঘোরাফেরা করলেও বাঘাইহাট কোন কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। এদিকে পাহাড়ি বাঙালি সাধারণ জনগণ তাদের অত্যাচার হয়রানিতে চরমভাবে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। জোন কর্তৃপক্ষের কাছে এ বিষয়ে বার বার অভিযোগ দেয়া হলেও জনগণ কোন প্রতিকার পায়নি। এ অবস্থায় ১৮ জুন অনন্যোপায় হয়ে তারা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বাধ্য হয়। সমাজে যাদের ন্যায়বিচার করার দায়িত্ব তারা যখন নিজেরাই অন্যায়-অবিচার শুরু করে, তখন জনগণের অবশ্যই প্রতিবাদ করার, বিদ্রোহ করার অধিকার রয়েছে।

গত ১৮ জুন বাঘাইহাট বাজারে ঠ্যাঙাড়েদের বিরুদ্ধে জনতার প্রতিরোধের একটি চিত্র। 

বাঘাইহাট জোন কর্তৃপক্ষ বলে আসছিল যে, ঠ্যাঙাড়েরা অস্ত্রধারী নয়, তারা নিরস্ত্র, যদিও এলাকার লোকজন তাদেরকে বরাবরই সশস্ত্র অবস্থায় দেখেছে। এমনকি কোন কোন মুরুব্বী সেনা কর্তৃপক্ষকে প্রস্তাব দেন একসাথে ঠ্যাঙাড়েদের ডেরায় গিয়ে দেখে আসতে তারা আসলে সশস্ত্র নাকি নিরস্ত্র। কিন্তু জোন কর্তৃপক্ষ তাতে রাজী হয়নি। এরপর ১৮ জুন ঠ্যাঙাড়েরা নিজেরাই সেনাদের চোখের সামনে গুলি চালিয়ে নাঈমকে হত্যা করে প্রমাণ করে দেয় তারা অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দ্বারা সুসজ্জিত।

বলা হয় পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত। যদি তাই হয়, তাহলে বাঘাইহাট জোনের সেনাদের দায়িত্ব ছিল অবৈধ অস্ত্রধারী ঠ্যাঙাড়েদের তক্ষণা গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা। কিন্তু তারা সেটা করেনি এবং না করার কারণ ব্যাখ্যাও তারা আজ পর্যন্ত দেশবাসীর সামনে দেয়নি। অন্যদিকে ঠ্যাঙাড়েরা ঘটনার পর সেনা ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়ে বিক্ষোভে অংশ নেয়া লোকজনকে বিভিন্নভাবে হুমকি দিতে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, তারা ২০ জুন হুমকি দিয়ে কাট্টলিতে লোকজন ডেকে মিটিং করে দম্ভোক্তি করতে থাকে এবং জনগণের বিরুদ্ধে তাদের ভাষায় “যুদ্ধ” ঘোষণা করে। অপরদিকে সাধারণ জনগণ সাজেক গণঅধিকার রক্ষা কমিটি গঠন করে এবং খুনীদের গ্রেফতার ও বাঘাইহাট জোনের অধিনায়ক লে. ক. খায়রুল আমিন ও বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শিরীন আক্তারকে প্রত্যাহারের জন্য ৪৮ ঘন্টার সময়সীমা বেঁধে দেন। কিন্তু প্রশাসন ঠ্যাঙাড়েদের গ্রেফতার না করে গোপনে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়। গতকাল ২১ জুন ১২টায় উক্ত আলটিমেটাম শেষ হলে কমিটি বিকেলে সমাবেশ করে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়।

এদিকে গতকাল (২১ জুন) জোন কর্তৃপক্ষ এলাকার পাহাড়ি বাঙালি কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে ক্যাম্পে ডেকে মিটিং করে। সেখানে ক্যাপ্টেন তানভীর খুনী ঠ্যাঙাড়েদের কেন গ্রেফতার করা হলো না তার কারণ ব্যাখ্যা দেননি। বরং তিনি ২০০৮ ও ২০১০ সালের মতো পরিস্থিতি ঘটানোর হুমকি দেন। এমনকি সাজেকেও প্রয়োজনে বান্দরবানের মতো অবস্থা সষ্টি করা হবে বলে জানান। তানভীর ঠ্যাঙাড়েদেরকে বাঘাইহাটে নিয়ে আসার দায় উপর মহলের ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের কলুষমুক্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা চালান।

ঠ্যাঙাড়ে সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহত মো. নাঈম।

নাঈম হত্যার পরও খুনী ঠ্যাঙাড়েদের গ্রেফতার না করে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেনাবাহিনী আবারও প্রমাণ করেছে যে, তারা ঠ্যাঙাড়েদের দিয়ে পাহাড়কে অস্থিতিশীল ও অশান্ত করে রাখতে চায়। ইতিপূর্বে খাগড়াছড়ি শহরের স্বনির্ভরে, পানছড়ির অনিলপাড়ায় ও মহালছড়িসহ বিভিন্ন এলাকায় তাদেরকে দিয়ে হত্যালীলা চালানো হয়েছে। সেসব খুনের সাথে জড়িতদেরও আজও গ্রেফতার করা হয়নি।

নাঈম হত্যার সাথে জড়িতদের গ্রেফতারের ও দায়িত্ব পালনে অবহেলার জন্য লে. ক. খায়রুল আমিন ও শিরীন আক্তারকে প্রত্যাহারের দাবি অত্যন্ত যৌক্তিক। সাজেকে অশান্ত পরিস্থিতির জন্য তারা কোনভাবে দায় এড়াতে পারেন না। যারা নিজেদের ক্যাম্পের পাশে থাকা সন্ত্রাসীদের দেখতে পায় না, তাদের নাকের ডগায় খুনের ঘটনার পরও খুনীদের গ্রেফতার করে না, তাদের কাছে কীভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার মতো গুরুদায়িত্ব দেয়া যায়? এ ধরনের লোকের কাছে কীভাবে জনগণের জান-মাল নিরাপদ থাকবে? #



সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।







0/Post a Comment/Comments