শহীদ বিপুল চাকমা, সুনীল ত্রিপুরা, লিটন চাকমা ও রুহিন বিকাশ ত্রিপুরা। ফাইল ছবি |
নিজস্ব প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪
আজ ১১ ডিসেম্বর ২০২৪ বিপুল চাকমা, সুনীল ত্রিপুরা, লিটন চাকমা ও রুহিন বিকাশ ত্রিপুরা হত্যার ১ বছর পুর্ণ হলেও খুনিরা রয়েছে এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে! গত বছর (২০২৩) এই দিনে রাতের অন্ধকারে খাগড়াছড়ির পানছড়িতে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ মদদে ঠ্যাঙাড়ে নব্যমুখোশ সন্ত্রাসীরা তাদেরকে নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করে।
বিপুল চাকমা ছিলেন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাবেক সভাপতি ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, সুনীল ত্রিপুরা ছিলেন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি, লিটন চাকমা ছিলেন গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের খাগড়াছড়ি জেলা সহসভাপতি ও রুহিন ত্রিপুরা ছিলেন ইউপিডিএফের একজন সদস্য।
ঘটনার দিন তারা সাংগঠনিক কাজে গিয়ে পানছড়ির লোগাং ইউনিয়নের পুজগাঙের
অনিল পাড়া নামক গ্রামে একটি বাড়িতে রাতযাপনের জন্য অবস্থান করছিলেন। রাত আনুমানিক
সাড়ে ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে নব্যমুখোশ বাহিনীর একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী বিপুলদের অবস্থান
করা বাড়িটি ঘেরাও করে তাাদের ওপর হামলা চালায়। সন্ত্রাসীরা খুবই নৃশংসভাবে বিপুল
চাকমা, সুনীল ত্রিপুরা, লিটন চাকমা ও রুহিন ত্রিপুরাকে গুলি করে হত্যার পর সেখান থেকে
চলে যায়।
নব্যমুখোশ সন্ত্রাসীরা বিপুল, সুনীল, লিটন ও রুহিনকে গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ফাইল ছবি |
এ ঘটনায় সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ মদদ ছাড়াও সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস’রও যোগসাজশ ছিল বলে জানা যায়।
উক্ত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশে ব্যাপক প্রতিবাদ-বিক্ষোভ
সংগঠিত হয়। নিন্দা-প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়।
কিন্তু ঘটনার এক বছরেও খুনিদের কাউকে এখনো গ্রেফতার করা হয়নি। এই খুনিরা এখনো সেনাবাহিনীর ছত্রছায়ায় খুন, অপহরণসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি গত ৩০ অক্টোবর উক্ত সন্ত্রাসীরা পানছড়িতে আবারো একইভাবে গুলি করে তিন ইউপিডিএফ সদস্যকে হত্যা করেছে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর ড. ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে হাসিনার আমলে সেনাবাহিনী দ্বারা সৃষ্ট ঠ্যাঙাড়ে নব্যমুখোশ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। উপরন্তু হাসিনার আমলে নিয়োজিত সেনা কর্মকর্তাদের একটি কায়েমী স্বার্থবাদী অংশ উক্ত সন্ত্রাসীদের এখনো আশ্রয়-প্রশ্রয় ও মদদ দিয়ে খুন-খারাবিসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার অভিযোগ রয়েছে।
এলাকাবাসী অবিলম্বে বিপুলসহ চার খুনে জড়িত ঠ্যাঙাড়ে নব্যমুখোশ সন্ত্রাসী ও মদতদাতাদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং খুনি নব্যমুখোশ বাহিনীকে ভেঙে দেয়ার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন।
চার শহীদের সংক্ষিপ্ত জীবনী:
শহীদ বিপুল চাকমা ১৯৯১ সালের ১৪ নভেম্বর খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার
৩নং চেঙ্গী ইউনিয়নের করল্যাছড়ির বুদ্ধরাম পাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম
সুনয়ন চাকমা ও মাতার নাম মৃত নীরুদেবী চাকমা। দুই ভাই-বোনের মধ্যে তিনি বড় ছিলেন।
তিনি ২০০৭ সালে লোগাং উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, ২০০৯ সালে খাগড়াছড়ি
সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও ২০১৪ সালে বিবিএ এবং পরবর্তীতে ঢাকায় বাঙলা কলেজ
থেকে এমবিএ সম্পন্ন করেন।
রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার বিপুল চাকমা পাহাড়ি জাতিসত্তার
আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষে ২০০৮ সালে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের খাগড়াছড়ি
সরকারি কলেজ কমিটিতে সদস্য হিসেবে যুক্ত হন। পরবর্তীতে খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজ ও খাগড়াছড়ি
জেলা শাখার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে ২০১৮ সালে ২৪তম কাউন্সিলের মাধ্যমে পাহাড়ি
ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত হন। ছাত্র রাজনীতির শেষে ২০২৩ সালে তিনি
গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং মৃত্যুর
আগ পর্যন্ত তিনি সে পদে বহাল ছিলেন।
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের দায়িত্ব পালনকালে ২০১৬ সালের ২৩ অক্টোবর পানছড়ির নিজ বাড়ি থেকে অসুস্থ মাকে খাগড়াছড়ি হাসপাতালে নেওয়ার পথে পানছড়ি থানার সামনে গাড়ি আটকিয়ে অসুস্থ মায়ের সামনে তাঁকে টেনে হিঁচড়ে বের করে পুলিশ ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করে। ছেলের এমন দৃশ্য দেখে অসুস্থ মা ঐ দিন দিবাগত রাতেই হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। ষড়যন্ত্রমূলক ১২টি মিথ্যা মামলায় আড়াই মাস কারাবরণের পর ২০১৭ সালের ১০ জানুয়ারি বিপুল চাকমা জামিনে মুক্ত হন।
বিপুল চাকমা শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জেল-জুলুম, নির্যাতন, হুমকি
ও ভয়-ভীতি তোয়াক্কা না করে পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণস্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য
এক লড়াকু যোদ্ধা হিসেবে নিরলসভাবে সংগ্রাম করে গেছেন। এছাড়া সমতলেও বিভিন্ন গণতান্ত্রিক
আন্দোলনের সাথে তিনি নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী
সংগঠনের সাথে একাত্ম হয়ে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম পরিচালনায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এর মধ্যে
ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন ও কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্র আন্দোলন, কুমিল্লায়
সোহাগী জাহান তনু হত্যার প্রতিবাদে আন্দোলন, গোবিন্দগঞ্জে সাওতাল পল্লিতে অগ্নিসংযোগের
প্রতিবাদ ও সারাদেশে খুন-গুম-হত্যা-ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলনের সামনে সারিতে ছিলেন বিপুল
চাকমা।
শহীদ সুনীল ত্রিপুরা ১৯৯৩ সালের ১ নভেম্বর খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার ১নং বর্ণাল ইউনিয়নের সুরেন্দ্র রোয়াজা হেডম্যান পাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সুখেন্দু বিকাশ ত্রিপুরা ও মাতার নাম গাইরিংতি ত্রিপুরা। পরিবারের চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়।
সুনীল ত্রিপুরা ২০১০ সালে তবলছড়ি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, তবলছড়ি গ্রীন হিল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও পানছড়ি সরকারি ডিগ্রী কলেজ থেকে বিবিএ সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে ২০২২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শারিরীক শিক্ষা বিভাগে ইচঊউ কোর্সে ভর্তি হন।
তিনি ২০১০ সালে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)-এর মাটিরাঙ্গা উপজেলা শাখার সহ-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরে পানছড়ি ডিগ্রী কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় পানছড়িতে পিসিপির সাংগঠনিক কার্যক্রম বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ২০১৫ সালে খাগড়াছড়ি জেলা শাখার ১৪তম কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক এবং ২০২১ সালে পিসিপির ২৫তম কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান কমিটিতে সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন।
সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে ২০১৮ সালের ২ জুন ঢাকায় আশুলিয়ার বুড়িরবাজার থেকে তিনি গ্রেফতার হন। আম্বেদকর চাকমার নেতৃত্বে জেএসএস সংস্কারপন্থীরা ষড়যন্ত্র করে মিথ্যা মামলায় পুলিশ লেলিয়ে দিয়ে তাকে ও রিপন চাকমাকে ধরিয়ে দেয়। এসময় তাঁরা ১২ জুন কল্পনা চাকমা অপহরণের ২১ বছর উপলক্ষে ঢাকায় কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে সাংগঠনিক মিটিং ও প্রচারপত্র বিলি করতে সেখানে গিয়েছিলেন। ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলায় দীর্ঘ ২ বছর ৬ মাস কারাভোগ করে ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর রাঙামাটি জেলা কারাগার থেকে তিনি জামিনে মুক্তি লাভ করেন।
জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর পরই তিনি আবার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন এবং পাহাড়ি
ছাত্র পরিষদের সাংগঠনিক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। হীন ব্যক্তি স্বার্থ ও আত্মপ্রতিষ্ঠার
মোহ দ্বারা তিনি কখনো চালিত হননি। এমনকি তার নিজ ভাইয়ের মৃত্যুও তাকে বিচলিত করতে
পারেনি।
উল্লেখ্য, সুনীল ত্রিপুরার আপন বড় ভাই ইউপিডিএফ-এর সংগঠক সুনীল বিকাশ ত্রিপুরা
(কাথাং)-কেও সেনা মদদপুষ্ট নব্যমুখোশ ও জেএসএস সংস্কারপন্থী সন্ত্রাসীরা হত্যা করেছিল।
শহীদ লিটন চাকমা ১৯৯৫ সালের
৩ জুন খাগড়াছড়ি জেলার ভাইবোনছড়া ইউনিয়নে দ্রোনাচার্য পাড়ায় জন্ম গ্রহণ করেন।
তাঁর পিতার নাম মৃত চিন্তা মুনি চাকমা ও মাতার নাম বালা চাকমা। ৬ ভাইবোনের মধ্যে লিটন
চাকমা ছিলেন পঞ্চম।
তিনি রঞ্জনমনি পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ২০১২ সালে মুনিগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, ২০১৬ সালে পানছড়ি সরকারি ডিগ্রী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেন। এরপর তিনি ২০১৯ সালে ঢাকায় গুলশান কলেজে ভর্তি হন।
লিটন চাকমা ২০০৯ সালে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাথে সম্পৃক্ত হন। তিনি খাগড়াছড়ি
সদর থানা শাখা ও পরে খাগড়াছড়ি জেলা শাখায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে
২০১৮ সালে গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের যোগ দেন।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের খাগড়াছড়ি জেলা শাখার
সহ—সভাপতি ছিলেন।
শহীদ রুহিন বিকাশ ত্রিপুরা খাগড়াছড়ির
পানছড়ি উপজেলার ৫নং উল্টাছড়ি ইউনিয়নে পদ্মিনী পাড়ায় ১৯৭৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন।
তারা পিতার নাম জনাধন ত্রিপুরা ও মাতার নাম মনিহরি ত্রিপুরা। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি
ছিলেন দ্বিতীয়।
তিনি উল্টাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। স্বৈরশাসক এরশাদের শাসনামলে পানছড়িতে এক ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হলে তাঁরা সপরিবারে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হন। সেখানে (ভারতে) তিনি অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। এরপর ১৯৯২ সালে তাঁর বাবা পরিবারের সবাইকে নিয়ে নিজের মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন।
তিনি ২০১৫ সালে ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)-এ যোগ দেন
এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পানছড়ি এলাকায় পার্টির সাংগঠনিক দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।
রুহিন ত্রিপুরা ভূমি বেদখলসহ শাসকগোষ্ঠীর পাহাড়ি বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার
ছিলেন।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।