""

‘আদিবাসী’ শিক্ষার্থী-জনতার কর্মসূচিতে সন্ত্রাসী ও পুলিশি হামলার নিন্দা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের

 গত ১৫ জানুয়ারি এনসিটিবি ভবনের সামনে “সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র জনতার’ কর্মসুচিতে অংশগ্রহণকারীদের ওপর হামলা করে স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টিরে সন্ত্রাসীরা

ঢাকা প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারি ২০২৫

‘আদিবাসী’ শিক্ষার্থী-জনতার গণতান্ত্রিক নাগরিক অধিকারের কর্মসূচিতে সন্ত্রাসী ও পুলিশি হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক।

আজ শুক্রবার (১৭ জানুয়ারি ২০২৫) সংবাদ মাধ্যমে দেওয়া এক বিবৃতিতে সংগঠনটি এই নিন্দা প্রতিবাদসহ হামলাকারী ও তাদের মদদদাতাদের রাজনৈতিক পরিচয় জনসমক্ষে প্রকাশসহ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানায়।

 বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যেদিন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিযুক্ত সংবিধান সংস্কার কমিশন রাষ্ট্রের সাংবিধানিক নাম 'জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ' ও রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি হিসেবে সংবিধানে 'বহুত্ববাদ'কে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করে খসড়া প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, ঠিক সেদিন ও পরের দিন এই রাষ্ট্রের তথাকথিত জাতিগরিমার বলি হয়েছেন বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠী। তাদের গণতান্ত্রিক নাগরিক অধিকারের বিক্ষোভ কর্মসূচিতে হামলা করেছে সংখ্যাগুরুর আত্মরম্ভিতায় উজ্জীবিত সন্ত্রাসীরা ও রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনী।

জুলাই-আগস্টের উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতির পর বিগত কয়েক মাস ধরে যা চলে আসছিল, গত কয়েকদিনে রাষ্ট্রের এই স্বেচ্ছাচারী অপরিবর্তিত চরিত্র এবং সরকারের এই নিপীড়নমূলক ভূমিকা গণতন্ত্রকামী যেকোনো মানুষকে আশঙ্কাগ্রস্ত ও আতংকিত করে তুলেছে। স্পষ্টত এই সরকার জাতি-ধর্ম-শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে শক্তিশালীর অন্যায়ের প্রতি দুর্বলতা ও শক্তিহীনের ক্ষোভের প্রতি কাঠিন্য পোষণ করছে। অথচ, গণতন্ত্রের জন্য আমাদের যে দীর্ঘ সংগ্রাম সেটারই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে আমরা সদ্যই সমতা, বৈষম্যহীনতা, সমঅধিকার আর সমমর্যাদার উদ্দেশ্যে সমবেত হয়েছিলাম চব্বিশের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে। সেই সমবায়ের অংশীদার হয়েও, বিগত সময়ের মতো 'বৈষম্যহীন বাংলাদেশে'ও নিজেদের ‘ঝরা পাতা’ হিসেবে আবিষ্কার করা আদিবাসী শিক্ষার্থী-জনতা স্বভাবতই আজ ক্ষুব্ধ। তাদের এই ক্ষুব্ধতার সঙ্গে আমরাও সংহতি ও একাত্মতা প্রকাশ করি এবং তাদের প্রতি রাষ্ট্র-সরকার ও সংখ্যাগুরুর হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।

বহুত্ববাদী সংস্কৃতিতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে পরিচিতির সম্মিলন বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য তৈরি করবে—এটিই হলো গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। বাংলাদেশেও এই গণআকাঙ্ক্ষা বিদ্যমান। সেই আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলণ হিসেবে বৈচিত্রের মধ্যে জাতীয় ঐক্যের বার্তা পৌঁছে দেয়া একটি বৃক্ষের ছবি জুলাই আন্দোলনের দেয়ালচিত্র (গ্রাফিতি) হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। এই 'ঐক্য-বৃক্ষে'র দেয়ালচিত্রটি যখন স্কুল পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তকের প্রচ্ছদে স্থান পেল, তখন আমরা আরও আশাবাদী হলাম। একেকটি পাতায় একেকটি পরিচয় সম্বলিত বৃক্ষটির শেকড়ের পাশে আদতেই একটি মঙ্গলবার্তা ছিল: 'পাতা ছেঁড়া নিষেধ'। কী চমৎকার বহুত্ববাদী বহিঃপ্রকাশ! অথচ, আমরা বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হয়ে আবিষ্কার করলাম, আমাদের ঐক্যের শেকড়ে কুঠারাঘাত করা হয়েছে!

বৃক্ষের ‘আদিবাসী’ নামাঙ্কিত পাতাটির প্রতি ইঙ্গিত করে ‘স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি’ (সম্ভবত ফরাসি থেকে ইংরেজিতে আগত sovereignty শব্দটির অপভ্রংশ) নামক একটি ভুঁইফোঁড় সংগঠন আদিবাসীদের অবমাননাকর "উপজাতি" তকমা দিয়ে সেই প্রচ্ছদটি অপসারণের অযৌক্তিক দাবি তোলে। এই সংগঠনের ন্যাক্কারজনক আপত্তির প্রতি সম্মতি জ্ঞাপন করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) দেয়ালচিত্রের প্রচ্ছদটি বাতিল করে ব্যাখ্যা দেয় যে, আদিবাসী শব্দটি সংবিধানসম্মত নয় বিধায় প্রচ্ছদটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কী নিদারুণ বৈষম্যবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছে এ সরকার! বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ২০১১ সালে অযৌক্তিকভাবে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ধারা ২৩(ক)-তে অত্যন্ত আপত্তিজনক "উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়" প্রপঞ্চগুলো সন্নিবেশিত করেছিল। পরিহাসের বিষয়, জুলুমশাহীর সংবিধানকে সংস্কারের লক্ষ্যে কমিশনের খসড়া প্রস্তাব যখন সামনে এসেছে, তখন সেই সংবিধানেরই দোহাই দিয়ে আদিবাসীদের 'অপর' করার পাঁয়তারা করছে সরকার! 

সরকারের এমন বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদে বিক্ষোভ প্রকাশ করতে গত ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে এনসিটিবি কার্যালয়ের সামনে আদিবাসী শিক্ষার্থী-জনতা বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দেয়। শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচি চলাকালে, কোনো ধরনের উস্কানি ছাড়াই তথাকথিত ‘সভারেন্টি’র গুণ্ডাবাহিনী লাঠি ও জাতীয় পতাকা মোড়ানো ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প দিয়ে আদিবাসী শিক্ষার্থী-জনতাকে দানবীয় কায়দায় গুরুতরভাবে আহত করে। পূর্বপরিকল্পিত এই একপাক্ষিক আক্রমণকে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হিসেবে জনপরিসরে প্রচারের জঘন্য উদ্দেশ্য নিয়ে আক্রমণকারীরা নিজেরাই আহত হওয়ার নাটক মঞ্চস্থ করে। অথচ আমরা দেখেছি, কাদের আক্রমণে কারা আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রমণের শিকার আদিবাসী শিক্ষার্থী-জনতার একটি বড় অংশ মারাত্মকভাবে আহত হয়ে বর্তমানে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

সন্দেহাতীতভাবেই, রাষ্ট্র ও সরকারের এমন কদর্য চেহারা আমরা এত দ্রুত প্রত্যাশা করিনি। আমরা জানতে চাই, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সংগ্রামী শ্রেষ্ঠা, ম্রং, ইসাবাসহ গুরুতরভাবে আহত বাকি শিক্ষার্থীরা কীসের মাশুল দিচ্ছেন? হামলা চলাকালে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা যেহেতু স্বৈরাচারের সহযোগী পুলিশ বাহিনীকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, তাই আমরা এটাও জানতে চাই, বর্তমান সরকারও স্বৈরাচারী কায়দায় পুলিশকে ব্যবহার করছে কি না? আগের দিন আদিবাসীদের ওপর হামলার সময় নিষ্ক্রিয় থাকা পুলিশ পরদিন ১৬ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে প্রতিবাদমুখর ছাত্র-জনতার ওপর হাসিনাশাহীর আমলের মতোই মারমুখী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। আমরা স্পষ্টত বুঝতে পারছি, রাষ্ট্রের মদদে প্রথমে অসরকারি বাহিনী দিয়ে আদিবাসীদের কণ্ঠরোধের চেষ্টা চালানো হয়েছে, পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র নিজেই সরকারি বাহিনী দিয়ে লাঠি, জলকামান, সাউন্ড গ্রেনেড হাতে দমনমূলক আচরণ করেছে। পুলিশের সংস্কার নিয়ে গরমাগরম আলাপ যখন চলমান, তখন পুলিশ বাহিনী কর্তৃক এই ন্যাক্কারজনক হামলায় আমরা স্তম্ভিত ও ক্ষুব্ধ।

১৬ জানুয়ারি সংক্ষুব্ধ ছাত্র জনতার স্বরাষ্ট্র্র মন্ত্রণালয় অভিমুখে মিছিলে হামলা চালায় পুলিশ। 

অ-সরকারি (ওরফে ছদ্মবেশি সরকারি) ও সরকারি সকল হামলাকারীর এবং তাদের মদদদাতাদের রাজনৈতিক পরিচয় আমরা জনসম্মুখে চাই। অত্যাবশ্যকীয়ভাবে, পরিচয় প্রকাশের পরপর, যথাযথ প্রক্রিয়ায় আমরা এই ফৌজদারি অপরাধের শাস্তি চাই। সহিংস উদ্দেশ্যে জাতীয় পতাকা ব্যবহারের কারণে এদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন মোতাবেক ব্যবস্থা গ্ৰহণ করার দাবি জানাই। সরকার এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে অবশ্যই এই প্রচ্ছদ বাতিলের কারণ দর্শাতে হবে। সন্তোষজনক জবাব না থাকলে মেরুদণ্ডহীনতার পরিচয় দেয়া সংশ্লিষ্ট দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তিস্বরূপ অপসারণ করতে হবে।

ফ্যাসিস্ট তরিকায় আর কোনো নিষ্পেষণমূলক এবং জনস্বার্থবিরোধী রাজনীতি বাংলাদেশে চলতে দেওয়া যাবে না। রাষ্ট্রের নীতিমালা নির্ধারণের ক্ষেত্রে সংখ্যালঘিষ্ঠ জাতি-ধর্ম-গোষ্ঠী-গোত্র-সম্প্রদায়কে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তাহলেই আমাদের প্রত্যাশিত ভেদাভেদহীন, বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ রচিত হবে।

এই ঘটনার প্রতিবাদে আগামীকাল শনিবার (১৮ জানুয়ারি) সকাল ১১টায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ দিকে (মানিক মিয়া এভিনিউ) বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করেছে বলেও বিবৃতিতে জানানো হয়।



সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।







0/Post a Comment/Comments