""

মানিকছড়িতে অন্যায় নির্যাতনের শিকার শিক্ষক থোয়াইচিং মং মারমা সুষ্ঠু বিচার পাবেন কী?

স্কুল শিক্ষক ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান থোয়াইচিং মং মারমাকে নির্যাতনের প্রতিবাদে এলাকাবাসীর মিছিল ও সমাবেশ। 
ছবিটি ৫ আগস্ট ২০২১ তোলা।

নিজস্ব প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ।। গত ৩ আগস্ট ২০২১ রাতে একদল সেনা সদস্য কর্তৃক অন্যায় নির্যাতনের শিকার হন মানিকছড়ি উপজেলার মম্প্রুতলী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক থোয়াইচিং মং মারমা। তাঁর বাড়ি ভোলাছোলা গ্রামে। তাঁর পিতা সাথেয়াইউ মগ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।

সেদিন রাতে তাঁকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে বেদম শারীরিক নির্যাতন করা হলে তিনি বাম হাতে প্রচণ্ড আঘাতপ্রাপ্ত হন। লোহার প্লাস দিয়ে টেনে ধরে তাঁর হাতের আঙুল জখম করে দেওয়া হয়। এ সময় তাঁর ৮০ বছর বয়সী বৃদ্ধ মাকেও টানাহেঁচড়া ও নির্যাতনের করা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।

নির্যাতের শিকার হওয়া শিক্ষক থোয়ইচিং মং মারমা বলেন, আমি মম্প্রুতলী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন সহকারি শিক্ষক। বিনা বেতনে আমি ওখানে শিক্ষকতা করি। আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। ২০১২ সালে রাঙামাটি জেলার দীপঙ্কর তালুকদারের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধার সম্মাননা স্মারক পেয়েছেন।

নির্যাতনের শিকার শিক্ষক থোয়াইচিং মং মারমা

সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘গত ৩ আগস্ট রাত ১১টার সময় সেনাবাহিনী এসে সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করে আমাকে ধরে নিয়ে মারধর করে। আমি মম্প্রুতলী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ও আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়ে সেনাবহিনীর সদস্যদের বললাম, আমি তো সন্ত্রাসী না। আমাকে এভাবে মারধর করছেন কেন? কিন্তু তারা আমার কোন কথাই শুনেনি। আমার কাছ থেকে অস্ত্র খুঁজতে থাকে। এ সময় আমি তাদেরকে বলি যে, আমিতো একজন শিক্ষক, আমার কাছে অস্ত্র থাকবে কোথায়? আমরাতো মানুষ গড়ার কারিগর। আমাদের কাজ কলম দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে আমাদের কাজ নয়। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পরিচয় দিয়েও সেদিন সেনা সদস্যরা আমাকে সাংঘাতিকভাবে মারধর করে। তারা আমার পায়ের তালুসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে মারধর করে আমার হাত ভেঙে দিয়েছে। তারা লোহার প্লাস দিয়ে হাতের আঙ্গুলে চেপে ধরে জখম করে দেয়। মানিকছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে ডা. আলাউদ্দিনের কাছ থেকে চিকিৎসা নিয়েছি। ৩/৪ হাজার টাকা খরচ হয়েছ’।

তিনি বলেন, সেদিন আমার ৮০ বছরের বৃদ্ধ মাকে পর্যন্ত তারা টেনেহিঁচড়ে ঘর থেকে বের করে। সেনা সদস্যদের পা ধরেও তিনি রেহাই পাননি। তারা আমার স্ত্রীকেও নির্যাতন করতে চেয়েছিলো। কিন্তু ছোট বাচ্চা থাকায় সেটা পারেনি।

তারা আমাকে বিনা অপরাধে চোখ বেঁধে নিয়ে মারধর করার পর রাত ২টা/আড়াইটার সময় ছেড়ে দেয়।

তিনি বলেন, সেনাবাহিনীতো দেশের রক্ষক। তারা রক্ষক হয়ে যদি সংখ্যালঘুদের উপর এমন নির্যাতন করে তাহলে আমরা যাবো কোথায়?

আমরাতো বাংলাদেশী। আমরাতো দেশের বাইরের কেউ নয়। আসলে আমরা সংখ্যালঘু পাহাড়ি হওয়ার কারণেই তারা আমাদের ইচ্ছেমত নির্যাতন করছে, সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করছে।

তিনি বিচার ও নিরাপত্তা দাবি করে বলেন, আমি প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে নিরাপত্তা ও সুবিচারের জন্য প্রার্থনা করছি।

শিক্ষক থোয়াইচিং মং মারমর পিতা বীর মুক্তিযোদ্ধা সাথোয়াইউ মগ

শিক্ষক থোয়াইচিং মং মারমার পিতা বীর মুক্তিযোদ্ধা সাথোয়াইউ মগ তাঁর মুক্তিযোদ্ধার সম্মাননা স্মারক দেখিয়ে বলেন, ১৯৭০ সালে আমার বাড়ি ছিল রাঙামাটির কাউখালীর কলমপতি মৌজার মাগ্যামা ছড়া গ্রামে। সে সময় আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। তবে মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত যেসব ডকুমেন্ট ছিল তার সবগুলো ১৯৮০ সালে কলমপতি ঘটনার (গণহত্যা) সময় পুড়ে যায়। তখন আমি অসহায় হয়ে কলমপতি মৌজা থেকে উদ্বাস্তু হয়ে মানিকছড়ির মম্প্রুতলী মৌজায় চলে আসি।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, ৩ আগস্ট রাতে সেনাবাহিনী এসে আমার ছেলেকে ধরে নিয়ে মারধর করেছে। আমি এর প্রতিবাদ জানাই।

তিনি বলেন, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধা হয়েও আমার ছেলেকে মারধর করা হয়েছে। এখন আমার পরিবারে পর্যন্ত নিরাপত্তা নাই। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারের কাছে এর সুবিচার চাই।

এলাকাবাসীর বিক্ষোভ :

উক্ত নির্যাতনের ঘটনার প্রতিবাদে ৫ আগস্ট ভোলাছোলা এলাকাবাসী বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে শিক্ষক নির্যাতন ঘটনার বিচার দাবি করেন।

সেই সমাবেশে মম্প্রুতলী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও ইউপি সদস্য ক্যজাই মারমা বলেন, আমি বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক থোয়াইচিং মং মারমাকে নির্যাতনের তীব্র নিন্দা প্রকাশ করছি। কোন প্রকার যাচাই-বাছাই না করে তাকে ডেকে নিয়ে মারধর করা হয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।

তিনি বলেন ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে তার জন্য এই সমাবেশ থেকে উক্ত নির্যাতনের ঘটনার সুবিচার দাবি করছি।

বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী তার শিক্ষকের উপর নির্যাতনের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, গত ৩ আগস্ট রাতে সেনাবাহিনীর সদস্যরা এসে আমাদের স্যারকে বিনা অপরাধে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে যেভাবে অমানবিক ও বিবেকহীনভাাবে নির্যাতন অত্যাচার করেছে আমরা ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে তার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।

তিনি প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর কাছে এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানান।

ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকের পক্ষ থেকে উগ্যজাই মারমা সমাবেশ বলেন, থোয়াইচিং মং মারমা এলাকার পিছিয়ে পড়া ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে নেয়ার জন্য বিনা বেতনে মম্প্রুতলী বহুমুখি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। তিনি একজন আদর্শবান শিক্ষক ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। সেনাবাহিনী একজন শিক্ষক ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তানকে এভাবে নির্যাতন করতে পারে না।

তিনি বলেন, যেখানে একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও শিক্ষক সমাজের নিরাপত্তা নেই, তাহলে সাধারণ জনগণের নিরাপত্তা কোথায় থাকবে?

তিনি সকল অভিভাবকের পক্ষ থেকে উক্ত নির্যাতনের ঘটনার নিন্দা জানান এবং সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সরকারের কাছে এর সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন।

বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য, সাবেক মহিলা মেম্বার ও নির্যাতিত শিক্ষকের ছোট বোন চাইনুচিং মারমা বলেন, গত ৩ আগস্ট রাত ১১টার সময় আর্মিরা নুশংসভাবে আমার বড় ভাইকে যেভাবে মারধর করছে তা বলার বাইরে। আমার বাবা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানকে যদি বিনা অপরাধে এভাবে নির্যাতন ও অত্যাচার করা হয় তাহলে এই স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের নিরাপত্তা দেবে কে? আমি এই নির্যাতনের তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাচ্ছি এবং বিচার দাবি করছি।

তিনি বলেন সেদিন আর্মিরা আমার ৮০ বছর বয়সী মাকে পর্যন্ত নির্যাতন ও টানাহেঁচড়া করেছে।

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দেশে যখন মুক্তিযুদ্ধ চলছিল তখন বাবা খেয়ে না খেয়ে স্ত্রী-সন্তান সবকিছু ত্যাগ করে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করতে গেছেন। কিন্তু এর বিনিময়ে আমরা কি পাচ্ছি? সরকার-প্রশাসন থেকে আমরা পাচ্ছি নির্যাতন, অত্যাচার ও লাঞ্ছনা। আমরা কী এটা চেয়েছি?

তিনি নির্যাতনকারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমার ভাই যদি অপরাধ করে থাকে তাহলে এখানে সমাজ আছে, ময়-মুরুব্বী আছেন, হেডম্যান-কার্বারি আছেন, মেম্বার আছে, স্কুল কমিটির সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক আছেন এবং এলাকাবাসী রয়েছেন। সবার কাছ থেকে আপনাদের যাচাই-বাছাই করা উচিত ছিলো। কিন্তু আপনারা তা না করে যারা দালাল হিসেবে আপনাদের সাথে কাজ করে তাদের মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে আমার শিক্ষক ভাইকে নির্যাতন করেছেন।

তিনি উক্ত নির্যাতনের ঘটনায় সুষ্ঠু ও ন্যায় বিচার দাবি করে করে বলেন, ভবিষ্যতে যেন এরকমভাবে গুজবে কান দিয়ে গভীর রাতে সাধারণ নিরীহ মানুষ নির্যাতিত না হয়, এটাই আমাদের দাবি।

তিনি মানিকছড়ি উপজেলার সকল দলের নেতৃবৃন্দের কাছেও এ বিষয়টি সুদৃষ্টিতে দেখার আহ্বান জানান।

কিন্তু উক্ত ঘটনার প্রায় ১ মাস হতে চললেও এখনো এর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের কোন পদক্ষেপ দেখা যায়নি। তাই, এলাকার জনগণের প্রশ্ন, সরকার-প্রশাসন তথা রাষ্ট্রের কাছে নির্যাতনের শিকার শিক্ষক থোয়াইচিং মং মারমা সুষ্ঠু বিচার পাবেন কী?





Post a Comment