সচিব চাকমা, আহ্বায়ক, কেন্দ্রীয় পুনর্গঠন কমিটি, পাহাড়ি গণ পরিষদ
[লেখাটি ২০০১ সালের ১ জানুয়ারি স্বাধিকার বুলেটিনের ১৭তম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিলো। সিএইচটি নিউজের পাঠকদের জন্য এই লেখাটি ধারাবাহিকভাবে এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।] (আজ শেষ পর্ব)
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ঘ) ১৭ নভেম্বর গণহত্যা প্রসঙ্গে: যে হত্যাকান্ডের জন্য জীবন বাবু প্রসিত খীসাকে দায়ী করতে চান তার মতলবটা কি? ’৯৫ সালে ধুধুকছড়ায় ১৫ জুন সন্তু লারমাও একইভাবে প্রসিত খীসাকে দায়ী করেন। এসব বলতে গেলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসবে। তর্কের খাতিরে যদি আমরা ধরেও নিই যে, সে সময় নানিয়াচরে প্রোগ্রাম দেয়াটা ঠিক হয়নি। তাহলে কি নিরস্ত্র মানুষের জনসভায় সেনাবাহিনী গুলি চালানোটা কি খুব ঠিক উচিত কাজ হয়েছে??? এসব কথা বলে জীবন বাবুরা কাকে লাভবান করতে চান?? এর অর্থ কি সেনাবাহিনীর অপকর্ম আড়াল করা নয়? হত্যাযজ্ঞের অপরাধ থেকে সেনাবাহিনীকে রক্ষা করা নয়? জীবন বাবুর কথাবার্তা তো রীতিমতো সেনাবাহিনীর পক্ষে যায়। এর নিগুঢ় অর্থ কি? কোন মহলের সবুজ সংকেত পেয়ে তারা এ ধরনের উল্টা-পাল্টা কথাবার্তা শুরু করেছিলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের পক্ষে রীতিমতো ওকালতি করতে নেমেছেন তা ফক্-ফকা হয়েছে খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে ’৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারী। যে সুতার টানে সন্তু লারমারা সুর সুর করে খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে জড়ো হন, তা তিনি গোপন করতে পারেননি। অস্ত্র সমর্পণ করে খুশীতে গল গদ হয়ে সন্তু লারমা সাংবাদিকদের কাছে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত স্মরণাতীত কালের ভয়াবহ “লোগাং হত্যাযজ্ঞ” আর “কল্পনা চাকমা অপহরণের ঘটনাকে” বিতর্কিত পর্যন্ত বলেছিলেন । (দেখুন: আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ, ১১ ফেব্রুয়ারি ’৯৮) সে জঘন্য মন্তব্যের জন্য জাতির কাছে সন্তু লারমাকে ক্ষমা ভিক্ষে করতে হবে। সন্তু লারমাকে লোগাং হত্যাযজ্ঞস্থলে আর কল্পনা চাকমার পৈতৃক ভিটেবাড়ীতে গিয়ে ক্ষমা চাইতে হবে। চির একুশের কবি সুকান্তের পংক্তিতে স্মরণ করে দিতে চাই, “আসিতেছে সুদিন, শুধিতে হইবে ঋণ। দিনে দিনে বাড়িতেছে সেনা, যুদ্ধ শেষে সুদে-আসলে দিতে হবে পাওনা।” পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ কড়ায়-গন্ডায় নিজেদের পাওনা বুঝে নেবে একদিন। নতুন সময়ের লড়াই শুরু হয়েছে। সেনাবাহিনীর অপরাধ আড়াল করে দিতে সন্তু লারমারা এখন কত কি বলছেন। সেনাবাহিনীকে দেশের গর্ব পর্যন্ত তিনি বলে ফেলেছেন। [দেখুন: বাংলাদেশ অবজারভার, ৮ সেপ্টেম্বর,২০০০] পার্বত্য চট্টগ্রামে এত হত্যাযজ্ঞের হোতা হচ্ছে সেনাবাহিনী। আজো তার জন্য সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের কাছে ক্ষমা চায়নি।
জীবন বাবুদের ভাষা ধার নিয়ে বলি, এটা অবিদিত নয় যে, নানিয়াচর হত্যাযজ্ঞের লাশ সামনে রেখে ’৯৩ সালের ২৪ নভেম্বর সন্তু লারমারা খাগড়াছড়ি সার্কিট হাউজে বৈঠক যোগ দিয়েছিলেন। নিহতদের স্মরণে সার্কিট হাউজে বৈঠক চলাকালে এক মিনিট দাঁড়িয়ে নিরবতা পালন করার মতো রাজনৈতিক সৌজন্য পর্যন্ত লেখাতে তারা ব্যর্থ হয়েছিলেন। হত্যাযজ্ঞস্থল পরিদর্শন তো দূরে থাকুক। সেদিন তারা সেটা করলে তা একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকতো। সরকার হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ন্যূনতম ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হতো। কি কারণে তা সন্তু লারমারা করেননি বা করতে পারেননি বলবেন কি? নাকি পিসিপি-পিজিপি প্রোগ্রামে যোগ দিয়ে সাধারণ লোক সেনাবাহিনীর গুলি খেয়ে মারা গেছে, কাজেই তাতে সন্তু লারমাদের কি আসে যায়! ঈ-ইল হোক্ আরো তারা পিসিপি-পিজিপি প্রোগ্রামে যোগ দেবে”-এই মানসিকতা থেকেই কি আপনারা এত বড় হত্যাযজ্ঞের পরও তেমন কোন ভূমিকা রাখেননি? উল্টো প্রসিত খীসাকে দোষ দিয়ে নিজেরা দায় মুক্ত হয়ে আছেন! নানিয়াচর হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হবার জন্য প্রসিত খীসাকে যদি দায়ী করেন, তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে আন্দোলন সংগ্রাম চলাকালে এ যাবৎ যত হত্যাযজ্ঞ হয়েছে, তার জন্য সন্তু লারমা চক্রই দায়ী। জীবন বাবু যুক্তি দিয়ে কথা বলতে শিখুন।
যে ঘটনায় প্রসিত খীসাকে দোষ চাপিয়ে আপনারা পুলকবোধ করেন, এখানে সবার জানার জন্য বলা দরকার যে, ১৭ নভেম্বরের নানিয়াচর প্রোগ্রামটা ছিলো স্থানীয়ভাবে গৃহীত। তা কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত নয়। যা নিয়ে প্রসিত খীসার উপর এত দোষ বর্তাছে তা তিনি জানতেনও না। প্রসিত খীসার নির্দেশ দেবার প্রশ্নই আসে না। নানিয়াচর এলাকার লোক এবং সংগঠনের একজন হিসেবে আমি সেই অভিশপ্ত দিনটির একজন প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম। ১৭ নভেম্বর রাত আট টা সাড়ে আটটার দিকে জগন্নাথ হলের মাঠে আড্ডা দেবার সময়ই তবে তিনি ঘটনা জানতে পারেন। জীবন বাবু মিথ্যাচার করা ঠিক নয়। তদন্ত রিপোর্টে সরকার এখনো পর্যন্ত প্রকাশ করতে পারেনি কেন? তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ হবার আগেই আপনারা আগ বাড়িয়ে প্রসিত খীসাদের দোষী রায় দিয়ে কাকে লাভবান করতে চান?
ঘটনাবলী সম্পর্কে অবহিত না হয়ে, আগ বাড়িয়ে কথা বলেন জীবন বাবু। যা জানেন না তা শুনুন, ২৭ অক্টোবর নানিয়াচর বাজারে পিসিপি'র প্রথম থানা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে তৎকালীন পিসিপি’র সভাপতি প্রসিত খীসা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। সে বারই নানিয়াচর বাজারে প্রথম বারের মতো মিছিল হয়। ঘাটের যাত্রী ছাউনিতে লোকজন বসতে যায়। তা সেনাবাহিনী চেকপোষ্ট বানিয়ে ফেলেছিলো। যাত্রী ছাউনিতে সেনা জওয়ানরা পিসিপি'র কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে রূঢ় আচরণ করলে নানিয়াচর বাজারে জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা ক্লাশ ফেলে লঞ্চ ঘাটে ছুটে আসে। পুরো বাজার সেনাবাহিনীর এতদিনের নিপীড়নের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয়। সেদিনই বিশাল ছাত্র-জনতার মিছিল প্রসিত খীসাদেরকে মহালছড়ির পথে এগিয়ে দেয়। সেদিনকার ঘটনায় প্রসিত খীসা ছিলেন। ১৭ নভেম্বরের প্রোগ্রামটা আসলেই তিনি জানতেন না। তা কেন্দ্রীয় কনসান্ডর্ ছাড়া হয়েছিল। সেনাবাহিনী কি নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার উপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে, সেটলারদের লেলিয়ে দিয়ে মানুষ খুন করে ঠিক কাজ করেছে কি জবাব দিতে চান জীবন বাবু-সন্তু লারমা???
ঙ) গোপন সার্কুলার,
চারু মজুমদারের লাইন, গণআদালত প্রসঙ্গে: পাহাড়ি গণপরিষদের গণ সচেতনতা সৃষ্টির
কার্যক্রমকে জীবন বাবু চারু মজুমদারের লাইন বলে বুঝে ফেলেছেন! এই আপনাদের রাজনৈতিকমান!!
জীবন বাবু আপনাকে জিজ্ঞেস করি, ‘চারু মজুমদারের লাইন’ কথাটি বুঝে বলছেন না শুনে বলছেন?
এত গুলিয়ে ফেললে আপনাদের সাথে কি রাজনৈতিক বিতর্ক করা যায়?! কলা আর কচুকে এক জিনিষ
মনে করলে সমস্যা হয় এ জায়গায়। লেখা দীর্ঘ হয়ে গেলেও বলতে হচ্ছে যে, চারু মজুমদারের
লাইন ছিলো শ্রেণী শক্র খতম। কোলকাতায় অবস্থান করে এ বিষয়গুলো জেনে নেননি!! পাহাড়ি
গণপরিষদ গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে গণতান্ত্রিক উপায়ে প্রতিবাদের ভাষা প্রয়োগ করতে জনতাকে
প্রস্তুত করার পদক্ষেপ নেয়। পশ্চিমা দেশে প্রায়ই প্রতিবাদ জানাতে ঘৃণিত ব্যক্তিদের
উদ্দেশ্যে পঁচা ডিম, টমেটো ছুঁড়ে মারা হয়। গণতন্ত্রের সুতিকাগার বলে কথিত ইংল্যান্ডে
অনেক মন্ত্রীকে জনতার রোষের শিকার হয়ে বহুবার পঁচা ডিম-টমেটোর দ্বারা আক্রান্ত হতে
হয়েছে। দৃষ্টান্ত বাড়িয়ে লাভ নেই। এ ধরনের প্রতিবাদের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে জীবন
বাবু চারু মজুমদারের লাইন বুঝে ফেলেছেন, অবাক হতে হয়। জীবন বাবু স্বীকার করেছেন, প্রসিত
খীসা ‘মাথা ব্যাথার জন্য মাথা কেটে ফেলার’ লোক নন। তাহলে পঁচা ডিম, টমেটো ছুঁড়ে মারাকে
ভিন্নভাবে চিত্রিত করার মানেটা কি? নাকি না বুঝার কারণে তিনি এসব গুলিয়ে ফেলছেন?
যে ‘গোপন সার্কুলার’ এর কথা উল্লেখ করেছেন তার বিরুদ্ধে রাঙামাটি আর খাগড়াছড়ির সেনা ব্রিগেড কেন ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠে? শংকিত হয়ে সেনা অফিসারেরা ঐ সার্কুলারের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালায়। পার্বতীসহ কয়েকটি সেনা নিয়ন্ত্রিত পত্রিকায় সার্কুলারটির বিরুদ্ধে বিভ্রান্তি ছড়ায়। সে সময় ছাত্ররা পঁচা ডিম ছুঁড়ে মারতে পারে এই ভয়ে রাঙামাটি ওমেন কলেজ উদ্বোধন করতে চট্টগ্রামের জিওসি ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। উদ্বোধন পর্ব সেরে কোথাও পা না বাড়িয়ে সোজা হেলিকপ্টারে চট্টগ্রামে ফিরে যান। যে জিওসি সেনাবাহিনী পরিবেষ্টিত হয়ে গহীণ অরণ্যে যেতে পারেন, পঁচা ডিমের ভয়ে তিনি রাঙামাটি ওমেন কলেজ উদ্বোধন করার সাহস পান না। গণতান্ত্রিক প্রতিবাদের ভাষার শক্তি এখানেই। গণপরিষদের ঐ সার্কুলারটি তখনকার সময়ে উর্ধ্বতন সেনা অফিসারদের হৃদকম্প শুরু করে দিয়েছিল। একইভাবে সন্তু লারমারাও ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন! তার মনে “ভবিষ্যত চিন্তা” তো ছিলোই! চুক্তি, সারেন্ডার আর আঞ্চলিক পরিষদের কথা তো তার পরিকল্পনায় ছিলো। “ভবিষ্যত চিন্তা” থেকেই তিনি সেনা অফিসারদের মেতো পণপরিষদের সার্কুলার আর কার্যক্রম ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। ধুধুকছড়ায় তো ১৫ জুন ’৯৫-এ প্রকাশ্য বলেও ফেলেছিলেন, জঙ্গী আন্দোলন করা যাবে না। গণদুশমন সমীরণের মাঝে “দেশপ্রেম” আবিষ্কার করেছিলেন। গাণিতিক সূত্র অনুযায়ী মাইনাস-মাইনাস=প্লাস, এখন সমীরণ-সন্তু দু’জন “দেশপ্রেমিক” মিলে “মহাদেশপ্রেমিক” বনে গেছেন। গণদুশমন সমীরণ নিয়েছিলো জেলা পরিষদ। সন্ত লারমা নিলেন ঘষামাজা করে “আঞ্চলিক পরিষদ”। পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্তু লারমার আবিষ্কৃত “দেশপ্রেমিকদের” উপদ্রবে সাধারণ নিরীহ জনগণের এখন প্রাণ যায় যায় অবস্থা।
’৮৯ সালে সন্তু লারমা গণদুশমন সমীরণের আখড়াতে মর্টার ছুঁড়েছিলেন। টাউন হলে গণদুশমন সমীরণকে মারতে এক্সপ্লোসিভ ফিট করতে নিরীহ ছেলে পাঠিয়েছিলেন। তারা গণদুশমন সমীরণকে মারতে গিয়ে ধরা পড়ে বহুদিন সেনাক্যাম্পের অন্ধকূপে নির্যাতন ভোগ করেছে। ঘটনাবলীর বয়ান তারাই ভালো দিতে পারবে।
গণদুশমন সমীরণকে ঘৃণা করলেও প্রসিত খীসারা সার্কুলার দিয়ে কাউকে খুনের নির্দেশ দেননি। সার্কুলার পেয়েও সে কারণে সেনা অফিসাররা আইনগতভাবে প্রসিত খীসাদের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারেননি। তাদেরকে বিপদে ফেলার জন্য কে সেনা ব্রিগেডে ঐ সার্কুলারটি সরবরাহ করেছে জবাব দেবেন সন্তু লারমা-জীবন বাবু???
গণআদালত নামের মাধ্যমেই তার কার্যক্রম বুঝা যায়। জনগণই সমাজের অনিষ্টকারীদের বিরুদ্ধে সালিশ বসিয়ে সাজা দেয়। সে ধরনের সালিশে খাগড়াছড়ির চোর, বাটপার, নারী পাচারকারী, দুর্বৃত্ত ভিলেজ পলিটিশিয়ান, আর্মির স্পাইয়ের সাজা হয়েছিল। আমাদের প্রথা ও সামাজিক বিচার অনুযায়ী সমাজ অনিষ্টকারীর চুল ন্যাড়া করা, জুতার মালা পরানো, পাড়ায় পাড়ায় ঘুরিয়ে শাস্তি দেয়া... এসব শাস্তি নতুন বা অপরিচিত নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে দেশের অন্যান্য জায়গায়ও এ ধরনের শাস্তি দেয়া হয়। সন্তু লারমারা কোন বিচার না করে সন্দেহের বশে গ্রামের বহু লোককে জীবন্ত কবর দিয়েছিলেন। গ্রামের পুঁচকি চোরকে কথায় কথায় মেরে ফেলেছিলেন। ডিম চোর, মুরগী চোর, ‘কলাছড়া’ চোর এদেরকে তারা মেরে ফেলতেন। জীবন বাবুর কথা মতো জেএসএস’এর সেই খুন-খারাবিকে চারু মজুমদারের লাইন বলা যাবে কি? চারু মজুমদারের লাইন নিয়ে অনেক সমালোচনা হতে পারে। মুস্কিল হচ্ছে জীবন বাবুরা চারু মজুমদারের লাইনটি না জেনেই উদাহরণ দেন। প্রসিত খীসারা সমস্ত ধরনের হত্যাকান্ড বন্ধ করতে চেয়েছিলেন এবং এখনো তাই চাচ্ছেন। সে কারণে সে সময় অপরাধীরা সজ্জা পেয়েছিলো বটে, কিন্তু কেউই জানে মরেনি। এটা আজ এখানে বলা দরকার যে, সে সময় ছাত্র-যুব সমাজ গণআদালত বসিয়ে চোর-আর্মি স্পাই-গ্রামের দালালদের শাস্তি দেয় বলেই সন্তু লারমারা তখন সীমানার ওপাড় থেকে এসে কাজ শুরু করতে পেরেছিলেন। নাহলে তারা এলাকায় পা রাখতে পারতেন না। এ কথা জনগণ এক বাক্যে স্বীকার করেন।
’৭১ এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’কে সন্তু লারমার ভয় পাবার হেতু কি? নিজে গোলাম আজমে পরিণত হওয়াতে এসব কথা শুনে শরীর হিম হয়ে যাচ্ছে কি? ভবিষ্যতে কোনদিন পার্বত্য চট্টগ্রামে জনতা আদালত বসালে তখন একই অপরাধে নিজেদেরও সাজা পেতে হবে এ আশঙ্কা থেকেই কি সন্তু লারমা এসবের বিরোধিতা করছেন? এখনো তো সন্তু লারমার বিচারের দাবি উঠেছে।
সন্তু লারমারা বিচার না করেই তো বহু নিরীহ মানুষ খুন করেছেন। এখনো করে যাচ্ছেন। ছাত্র-যুব সমাজের উদ্যোগে জনতা গণআদালত বসিয়ে সমাজ অনিষ্টকারী চোর, নারী পাচারকারী, দুর্বৃত্ত ভিলেজ পলিটিশিয়ান, আর্মি স্পাইকে সংশোধন করার জন্য সাজা দিলে তাতে সন্তু লারমারা ব্যাথা পাবার কারণ কি??? বিশেষ করে আর্মির স্পাই ভিলেজ পলিটিশিয়ান গণশত্রু প্রিয় কুমারের সাথে সন্তু লারমার এত সখ্যতার কারণ কি? শান্তি বাহিনীর সাজায় যার মৃত্যুদন্ড হওয়া ছিল অবধারিত। যার বিরুদ্ধে গণআদালতে ২৪টি গুরুতর অপরাধ প্রমাণিত হয়, যে নিজে দশ জনকে সাক্ষী রেখে মুচলিকা দেয়, জনতার সামনে ক্ষমা ভিক্ষে করে, সারেন্ডারের প্রাক্কালে সেই ধিকৃত প্রিয় কুমারের প্রতি সন্তু লারমা এত দর্বল হবার কারণটি কি? পিসিপি’র একনিষ্ট কর্মিদের সংগঠন থেকে সরিয়ে দেবার জন্য সেনাবাহিনীর নিয়োজিত স্পাই, সামান্য কেরাণী হয়েও যার বাড়িতে অফিসের ফোন লাগানো, ৩০ অক্টোবর ‘৯৩ ‘হুয়াঙ বোইও বা’ থেকে ৮ জন পিসিপি-পিজিপি নেতাকে যে ফোন করে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেয়, পিসিপি’র নেতা মিন্টু খীসার বাবার বিরুদ্ধে সেনা ব্রিগেডে মিথ্যা রিপোর্ট দিয়ে চাকুরীতে সাসপেন্ড করে রাখে, যে কারণে মিন্টু খীসার পড়ালেখা বন্ধ হবার উপক্রম হয়; পিসিপি নেতা সৈকত দেওয়ানকে আন্দোলন থেকে সরিয়ে দিতে তার বাবাকে সেনা ব্রিগেডে মিথ্যা রিপোর্ট দিয়ে দুর্গম এলাকায় বদলী করায়, পিসিপি’র সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বানচাল করে দিতে যে এক শিল্পীর বাবার উপর চাপ সৃষ্টি করে শিল্পীকে অনুষ্ঠানে যেতে দেয়নি, ... এ ধরনের গুরুতর অভিযোগ যার বিরুদ্ধে প্রমাণিত, আমি নিজে সে গণআদালতে একজন দর্শক ছিলাম। সেই গণশত্রু খাগড়াছড়িতে একটি বিকৃত ঘৃণিত নাম প্রিয় কুমারের সাথে সন্তু লারমার এত মাখামাখি হয়ে পড়ার কারণ কি? পরীক্ষিত স্পাইকে আবার এখানকার আন্দোলনের বিরুদ্ধে নিয়োজিত করার জন্য কি?
চ) রাঙামাটি প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী,
পূর্ণস্বায়ত্তশাসন ডাক, বৈঠক : জীবন বাবুর ভাষায়, “জেএসএস যেখানে ৫ দফা নিয়ে
আন্দোলন এবং আলোচনায় ব্যস্ত ঠিক সেই মুহুর্তে রাঙ্গামাটিতে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সময় তোমার পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের (নয়া রূপকথার গল্প) ডাকের জেরে
ব্যাপক অহেতুক আঘাত আর নানিয়াচরে আপনারই গোয়াতুর্মির কারণে ঘটে যাওয়া
১৭ নভেম্বরের গণহত্যা আমাদের বার বার আপনার নেতৃত্ব সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়।
এই একটি বাক্য জীবন
বাবুর কত ভুল আর তথ্য বিকৃতি রয়েছে তা এক এক করে এখানে তুলে ধরছি ।
[এক] রাঙামাটিতে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের তৃতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল ’৯২ সালের ২০ মে। সে সময় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ পূর্ণস্বায়ত্তশাসন ডাক দেয়নি। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ডাক ছিলো “স্বায়ত্তশাসনই” পার্বত্য চট্টগ্রামের একমাত্র রাজনৈতিক সমাধান”। পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের ডাক দেয়া হয় ‘৯৭ সালের ১০ মার্চ। ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সেদিন পিজিপি-পিসিপি-এইচডব্লিউএফ জাতির এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের ডাক দেয়। এই পুঁজি নিয়ে রাজনৈতিক আলোচনা করতে নেমেছেন জীবন বাবু?
(দুই) বিএনপি সরকারের সাথে জেএসএস’এর প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ’৯২ সালের ৫ নভেম্বর। জুলাই মাসে যোগাযোগ মন্ত্রী কর্ণেল অলি আহম্মদের নেতৃত্বে ৯ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠিত হয়েছিল। জেএসএস ’৯২ সালের ১০ আগষ্ট থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত এক তরফা যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা দেয়। রাঙামাটিতে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের তৃতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালনকালে জেএসএস “আলোচনায় ব্যস্ত থাকা” কথাটি সম্পূর্ণ উদ্ভট কাল্পনিক। কারোর উপর দোষ চাপাতে জীবন বাবুরা কত মিথ্যাচার আর ভন্ডামীর আশ্রয় নিতে পারে এটিই হচ্ছে তার জাজ্বল্য দৃষ্টান্ত। কমিটির গঠন যেখানে জুলাই মাসে, ২০ মে সন্তু লারমারা আলোচনায় ব্যস্ত থাকেন কিভাবে? পুরোপুরি না জেনে এ ধরনের আলোচনা কেন যে করতে চান জীবন বাবুরা সেটাই অবাক লাগে। তারা ভুল যাতে না করেন সে কারণে সন্তু লারমা আর জীবন বাবুদের জানা থাকার জন্য তথ্যগুলো জানিয়ে দেয়া উচিত মনে করছি। এরশাদ আমলে ’৮৮ সালের ১৪—১৫ ডিসেম্বর শেষ বৈঠক হয় আর তা ভেঙ্গে যায়। ’৯২ সালের ৫ নভেম্বরের আগ পর্যন্ত কোন বৈঠক হয়নি।
[তিন] তোমার পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের (নয়া রূপকথার গল্প) ডাকের জেরে ব্যাপক অহেতুক আঘাত এ কথাটির অর্থ কি জীবন বাবু-সন্তু বাবু? এই অধমকে এ ধরনের দুর্বোধ্য ভাষা বুঝিয়ে দিয়ে একটু জ্ঞান দিয়ে উদ্ধার করবেন কি??? “ব্যাপক অহেতুক আঘাত” জিনিষটা কি? সন্তু লারমা যেমন “পূর্ণস্বায়ত্তশাসন” কোন রাজনৈতিক বইয়ে দেখেননি আমাদেরও নির্দ্ধিধায় স্বীকার করতে হয় যে, কোন লেখক কলামিষ্টকে তো এ ধরণের গরুচন্তালী ভাষা ব্যবহার করতে আমরা দেখিনি।
[চার] পূর্ণস্বায়ত্তশাসন
আপনাদের বিবেচনায় ‘নয়া রূপকথার গল্প’। রূপকথা মানেই তো পুরানো দিনের গল্প। নাহ্!
জীবন বাবু-সন্তু বাবু আমরা “নয়া রূপকথার গল্প” কোন বইয়ে পাইনি, শুনিওনি। নানা-নানীদের
কাছ থেকে রূপকথা শুনেছি, তবে সেগুলো পুরানো কোন রাক্ষস বা দৈত্যের বা কোন রাজা-বাদশার
গল্প। আর এ যুগে টিভিতে বিজ্ঞানের কল্পকাহিনী দেখেছি। “নয়া রূপকথার গল্প” কি হতে পারে
সেটা এই অধমের বুঝার সাধ্য নেই ভাই!! আমাদের এই অজ্ঞানতাকে আপনাদের নয়া রূপকথার গল্প
দিয়ে হাজার বার হাসি-তামাশা করুন, তাই সই।
তবে, যেটা আপনাদের সবিনয়ে জানিয়ে দিতে চাই যে, পূর্ণস্বায়ত্তশাসন পার্বত্য চট্টগ্রামের আপামর জনসাধারণের প্রাণের দাবি। সে দাবি আদায়ের জন্য ইউপিডিএফ আন্দোলন সংগ্রাম করছে, আমিও এর একজন। পূর্ণস্বায়ত্তশাসন আপনাদের আর সরকারের কাছে আতঙ্কের ব্যাপার। কিন্তু জনগণের সেটাই হচ্ছে বাঁচার রক্ষা কবচ।
[পাঁচ] একই বাক্যে প্রসিত
খীসাকে “তোমার” আবার “আপনার” এই বিদঘুটে সম্বোধনও আমাকে বেশ ধাঁধায় ফেলেছে। আমাদের
সমাজের শ্বশুর-জামাতা কথা বললে যা হয়, খোলা চিঠি সম্পাদন করতে গিয়ে আপনাদের মধ্যে
তাই হয়েছে দেখছি। কাক ময়ুর পুচ্ছ লাগালেও ময়ুর হতে পারে না। স্বর তো লুকানো যায়
না। আধুনিক যুগের শশুর-জামাতা সাজতে চাইলেও পুরানো সংস্কার কি আর এত সহজে যায়! শুনেই
তো বুঝা যায় কোন স্বর কার।
এখানে মনে করিয়ে দেয়া দরকার যে, লোগাং লংমার্চ, রাঙামাটিতে স্বায়ত্তশাসনের ডাক দেশে বিদেশে ঝড় তুলেছিল, পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্যুকে প্রধান করে তুলেছিল। সে কারণেই বিএনপি সরকার কমিটি করে জেএসএস’এর সাথে বৈঠক করতে বাধ্য হয়। পিসিপি সে সময় আন্দোলন না করলে বিএনপি সরকার জনসংহতি সমিতির উদ্দেশ্যে সাধারণ ক্ষমাই ঘোষণা করতো, আলোচনার উদ্যোগ গ্রহণ করতো না। তখন জেএসএস ছিল বিপর্যস্ত। যে রাঙামাটি পিসিপি প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সারাদেশে ও বিদেশে সারা জাগিয়েছিলো, সে সময় দেশের পত্র-পত্রিকা জুড়ে ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রসঙ্গ। দেশে স্বায়ত্তশাসন দাবির প্রতি সমর্থন জোরদার হচ্ছিল, সে সময় সন্তু লারমারা রাঙামাটি—খাগড়াছড়ি সড়কে ছয়জন কাঠুরিয়া মেরে পিসিপি’র স্বায়ত্তশাসন ডাককে কিছুটা ধোঁয়াটে করে ফেলে। তার রাজনৈতিক গুরুত্বকে খাটো করে। সে সময় জেএসএস উল্টো পথে যাত্রা শুরু করেছিল। তারা কোন গঠনমূলক রাজনৈতিক কর্মসূচি তখন দিতে পারেনি। কল্পনা চাকমা দুর্বৃত্ত লেঃ ফেরদৌসের হাতে অপহৃত হলে সারাদেশে নিন্দার ঝড় উঠে। সেনাবাহিনীর অপকর্ম দেশবাসীর কাছে প্রচার হয়ে পড়ে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা নির্যাতনের বিষয়টি জোরালোভাবে পত্রিকায় প্রকাশ হতে থাকে। এ সময় লংগুদুর পাকোয়াখালীতে সন্তু লারমারা যে নারকীয় কান্ড ঘটায়, তাতে কল্পনা ইস্যুটি চাপা পড়ে যাবার উপক্রম হয়েছিল।
৯. চুক্তির দায়-দায়িত্ব : খোলা চিঠির রচয়িতা জীবন বাবু একেবারে প্রথম দিকে লিখেছেন “... এই চুক্তির জন্য প্রসিত বাবুরাও প্রত্যক্ষভাবে দায়ী...”। এ কথা দ্বারা এখানে এ অর্থই বুঝানো হচ্ছে যে, ‘পার্বত্য চুক্তি’ এমন বাজে, খারাপ ও ক্ষতিকর কিছু যার জন্য প্রসিত খীসারাও তার দায় এড়াতে পারে না। সোজাসুজি বললে তার জন্য তারাও অপরাধী। চুক্তিটি ভালো কিছু হয়ে থাকলে সে ব্যাপারে নিশ্চয়ই এ ধরনের “দায়ী” কথাটা উঠতো না। খারাপ, ক্ষতিকর কিছু হলেই তো তার জন্য দায়ী কথাটা উঠে। তাহলে চুক্তির তিন বছরের মাথায় তবেই জীবন বাবুদের হুশ হলো যে, ‘পার্বত্য চুক্তি’ আসলে খারাপ, ক্ষতিকর। তার আগে তা তারা বুঝেননি। কেউ বললেও শোনেন নি। বুঝতে চেষ্টা করেননি। ’৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর আর ’৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারীর দিকে তা ছিলো ঐতিহাসিক, যুগান্তকারী... আরো অনেক কিছু। তখনকার ঐ ঐতিহাসিক যুগান্তকারী চুক্তিটির জন্য আজকে যাদেরকে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী বলে অভিযোগ করছেন, সে ধরনের ঐতিহাসিক চুক্তির জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী ব্যক্তিদের “এত বড় কৃতিত্বের কথা কই সে সময় তো কাউকে বলার সাহস পাননি, চেপে গেছেন। বরং প্রসিত খীসাদের বিরুদ্ধে ঐ “ঐতিহাসিক যুগান্তকারী চুক্তি” বানচাল করে দেবার হাজার রকমের অভিযোগ করেছিলেন, পাকিস্তানের সাথে আঁতাত করেছে বলেছিলেন। এত বড় “ঐতিহাসিক চুক্তির” সুনাম-কৃতিত্ব কি আর প্রসিত খীসাদের “ভাগ” দেয়া যায়??? আপনাদের নীতি তো হচ্ছে ‘সুনাম যা আছে তা লুফে নিয়ে আঁকড়ে ধরে থাকা, আর অন্যদের বিরুদ্ধে দুর্নাম করা। তাদের বিরুদ্ধে কাল্পনিক অভিযোগ আনা’।
আসুন যুক্তির নিরিখে বিচার করে দেখি, চুক্তি বানচাল করে দেবার অভিযোগ প্রসিত খীসাদের বিরুদ্ধে করলে, চুক্তির জন্য তাদের কখনোই আপনারা দায়ী করতে পারেন না। যারা চুক্তি মানেনি, বানচাল করে দিতে চেয়েছিলো, তারা কিভাবে চুক্তির জন্য দায়ী হতে পারে??? আর চুক্তির জন্য যদি সত্যি সত্যিই দায়ী করলে, ঐ যে আপনারা আর সরকার চুক্তিকে “ঐতিহাসিক যুগান্তকারী” কি কি বিশেষণে বিশেষায়িত করেন, তার কৃতিত্বও প্রসিত খীসাদের ভাগে পড়বে!! যদিও প্রসিত খীসারা আপনাদের সাফল্য-কৃতিত্বের ভাণ্ডার থেকে কানাকড়িও ভাগ বসাতে চান না। তা তারা ঘৃণা করেন। সে রকমই ঘৃণা করেন আপনাদের অপকর্ম-হত্যালীলা-লাম্পট্য-নষ্টামিকে। জীবন বাবু আপনাদের ভেবে-চিন্তে কথা বলতে অনুরোধ করি।
১০. চুক্তি করতে বাধ্য হওয়ার কারণ: জীবন বাবু চুক্তি ও সারেন্ডারের সাফাই গাইতে চেয়েছেন। তার পেছনে “পাঁচটি মৌলিক কারণ” চিহ্নিত করেছেন। আর তাতে যোগ করেছেন “সম্ভবত” শব্দটি। তার মানে এখনো ঐ পাঁচটি কারণ নিয়ে আপনি নিশ্চিত নন, দ্বিধা—দ্বন্দ্ব কাজ করছে এখনো। চুক্তিতে আবদ্ধ হবার পেছনে জীবন বাবুর গবেষণালব্ধ পাঁচটি কারণ হচ্ছে এই : ১. দলীয় বাস্তবতা, ২. সাধারণভাবে জুম্ম জনগণের দীর্ঘদিনের সংগ্রামে অবসাদগ্রস্থতা, ৩. ছাত্র-যুবকদের আন্ডার গ্রাউন্ডে সংগ্রাম করার অনীহা এবং রাজপথের আন্দোলনে মোহগ্রস্থতা, ৪. দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি এবং ৫. প্রতিবেশী দেশ ভারত ও অন্তর্জাতিক বিশ্বের সার্বিক পরিস্থিতি। এখানে গবেষকের মতো তিনি বলছেন, “এই লিডিং পাঁচটি কারণের মধ্যে প্রথম তিনটিই এখানে আলোচ্য।”
প্রথম তিনটি কারণ তিনি আলোচনা করতে চান। শেষের ৪ ও ৫ নং কারণ দুটি কেন আলোচনায় আনতে চান না, তা করতে কি সমস্যা বা দুর্বলতা সে ব্যাপারে আমি প্রশ্ন উত্থাপন করতে চাই না।
জীবন বাবু একজন গবেষক-বিশ্লেষকের মতো পাঁচটি কারণ উল্লেখ করে জ্ঞানগর্ব আলোচনা শুরু করে দিচ্ছেন এমন ভাবভঙ্গী দেখিয়েছেন। কিন্তু যে কারণ চিহ্নিত করেছেন সে বিষয়েই তো কোন আলোচনা নেই। এখানেও কি জীবন বার পাঠকদের সাথে “ব্লাফ” দিতে নেমেছেন??? “ব্লাফ” দিতে পারা আর “অভিনয়” করতে পারাটা হচ্ছে আপনাদের কাছে “কূটনীতি”। ‘কারণ’ আপনারা শুধু উল্লেখই করতে জানেন, চিহ্নিত করণের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে জানেন না, নয়তো তা শিখেননি। আন্দোলন সংগ্রামের ক্ষেত্রেও তাই। আপনারা শুরু করেছেন, কিন্তু তা সফলভাবে সম্পন্ন করতে পারেননি। আমরাই আপনার গবেষণা কারণগুলো খতিয়ে দেখি:
(১) দলীয় বাস্তবতা: বেশ গুরুগম্ভীর কথা! কিন্তু তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ কোথায় জীবন বাবু?? নিম্ন মধ্যবিত্তের সাংসারিক প্যাঁচাল, ঘ্যানঘ্যানি, ব্যক্তি কুৎসা রটনা আর রাজনৈতিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এক জিনিষ নয়। এত বড় একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট ‘আ-গু-জো’ নিয়ে সব তো গুলিয়ে ফেলেছেন। কি পয়েন্ট ধরেছেন, আর কি কাসুন্দিতে মেতে উঠেছেন! খেই হারিয়ে কি বলতে কি বলছেন। লেজেগোবরে অবস্থাই করে ফেলেছেন। গোপাল ভাঁড় গরু হারিয়ে তার নিজের স্ত্রীকে ‘মা’ আর নিজের ছেলেকে ‘শালা’ ডেকেছিল। নীতি-আদর্শ হারিয়ে আপনাদেরও গোপাল ভাঁড়ের মতো মতিভ্রম হয়েছে দেখছি। কাকে কি ডাকতে হয়, কোন বিষয় কিভাবে আলোচনা করতে হয় কিছুই ঠাহর করতে পারছেন না। মতিভ্রম হয়ে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলেছেন আর বিষেদাগার করেছেন। কাউকে বাদ দেননি। শালীনতা, রুচিবোধ সব কিছুই খুইয়ে ফেলেছেন।
সমস্ত কথার সার কথা
হচ্ছে, প্রসিত খীসারা জনসংহতি সমিতিতে যোগ দেয়নি। সে কারণে সন্তু লারমারা চুক্তি আর
সারেন্ডার করতে বাধ্য হয়েছেন এ কথাই তো জীবন বাবু বুঝাতে চান? তাহলে যুক্তির নিরিখে
দেখলে এটাও এখানে প্রকাশ পায় যে, প্রসিত খীসারা জনসংহতি সমিতিতে যোগ না দিলে সমিতি
দুর্বল থাকে, আন্দোলন করতে পারে না। সরকারের সাথে চুক্তি ও সারেন্ডার করতে বাধ্য হয়।
মোটকথা তাদের ছাড়া জনসংহতি সমিতি আন্দোলন সংগ্রাম আর এক পাও চালিয়ে নিতে বা এগিয়ে
নিতে পারে না। কাজেই জেএসএস’এর চুক্তি ও সারেন্ডার করার পেছনে সমস্ত দোষ প্রসিত খীসাদের
উপর। জীবন বাবুদের দলীয় বাস্তবতাটা হচ্ছে এটাই তো?
প্রসিত খীসাদের কারণে
সন্তু লারমারা চুক্তি ও সারেন্ডার করতে বাধ্য হয়েছেন, আদৌ তাদের তা করার ইচ্ছা ছিল
না। অতি অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা তা করতে বাধ্য হয়েছেন এটাই তো কান্নাকাটি করে সন্তু
লারমারা দশ দিগন্ত প্রচার করে বেড়াচ্ছেন। এটা যদি যুক্তির খাতিরে মেনে নিই, তাহলে
এখানে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন এসে যায়, অন্যদের কারণে বাধ্য হয়ে আছেন কেন? কাগুজে চুক্তি
ও অথর্ব আঞ্চলিক পরিষদ আঁকড়ে থাকার জন্য কি প্রসিত খীসারা সন্তু লারমাকে বাধ্য করছে?
দালালিকে জায়েজ করতে খড়খুটো আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করছেন।
যে চুক্তি অনিচ্ছাসত্ত্বেও সন্তু লারমা করতে বাধ্য হন, সে চুক্তি লাথি মেরে ফেলে দিতে পারছেন না কেন? আঞ্চলিক পরিষদের গদি ছাড়তে পারছেন না কেন? রক্ত দেয়ার হাঁকডাক ছাড়তে পারলে গদি ছাড়তে না পারার হেতু কি? ওঝা-বৈদ্যরা গ্রামে ‘পিড়ি চালান’ দেবার মতো, সন্তু লারমাকেও কি কেউ ‘আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ার চালান’ দিয়েছে? নাহলে এত কথা বলার পরও কেন তিনি তা ছেড়ে দিতে পারছেন না?
আসল কথা হচ্ছে আন্দোলন
করে অধিকার প্রতিষ্ঠা সেটা সন্তু লারমার আগ্রহ ছিল না। জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির
মিটিঙে অন্য সদস্যদের তিনি আকারে ইঙ্গিতে শুধু একথাই বলতে বাকি রাখতেন “আপনারা থাকুন,
আন্দোলন করুন। আমি চলে যাই।” এ কথাটা খোদ জনসংহতি সমিতির উর্ধ্বতন কেন্দ্রীয় নেতারাই
প্রসিত খীসাদের কাছে স্বীকার করেছিলেন। বহু আগে থেকেই তিনি আত্মসমর্পণবাদী লাইন নিয়েছিলেন।
সন্তু লারমা সে কারণে তরুণ সংগ্রামী মনোভাবাপন্ন কর্মিদের সংগ্রামে উজ্জীবিত করার পরিবর্তে
শুধু হতাশামূলক কথাবার্তা বলতেন। তাদের মনোবল আর আত্মবিশ্বাস ধ্বংস করে দেয়া না গেলে
তো তিনি সরকারের সাথে হাত মিলাতে পারছেন না। কাজেই তিনি আন্দোলন গুটিয়ে ফেলার লক্ষে
সুপরিকল্পিতভাবে পার্টিতে হতাশা ছড়াতে থাকেন। সারেন্ডারের আগে পর্যন্ত গোটা পার্টির
নেতা-কর্মিরা ছিলেন হতাশ। কথায় কথায় তরুণ কর্মিদের শোনাতেন, “আন্দোলন আঘিয়্যং”
মানে সংগ্রাম করার ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। [সারেন্ডার করে খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে
সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন আজ সত্যিই আমার ভীষণ
ভালো লাগছে’।] আরো বলতেন ‘আন্দোলন করতে গিয়ে গাছে উঠেছি, নামতে পারছি না
আর’। সংগঠনের প্রধানের কাছ থেকে এ কথা শুনলে আন্দোলন সংগ্রামে কে উজ্জীবিত হবে?
জনগণকে দোষ চাপিয়ে বলতেন, “জনগণ আন্দোলন বিমুখ”। এ জনগণ দিয়ে হবে না, হয়
না। সাধারণ কর্মিরা জনগণের উপর অর্থাৎ মাটির উপর দাঁড়ানোরর সাহস হারিয়ে ফেললে তারা
আর আন্দোলন সংগ্রাম করতে মানসিক জোর পাবে না, হাতাশায় ভুগবে সেটা তো অবধারিত। সন্তু
লারমার ভাষায় “ছাত্র—যুব সমাজ সংগ্রামী নয়”। জনগণের উপর নির্ভর করার পথ নেই, তারা
“আন্দোলন বিমুখ”। তাহলে যাবার পথ থাকে আর কোথায়, একমাত্র সারেন্ডার ছাড়া! কাজেই সেভাবে
তিনি সবকিছু গুছাতে থাকেন। যুদ্ধ বিরতি দিয়ে কর্মিদের বসিয়ে রাখেন। বার বার যুদ্ধ
বিরতি বাড়িয়ে যেতে থাকেন। কোন কর্মসূচি নেই। স্বাভাবিকভাবে সমস্ত নেতা-কর্মিরা ঝিমিয়ে
পড়ে। এ মোক্ষম সময়ে সন্তু বাবু শেষ বানটি মারেন “জনগণ অকৃতজ্ঞ”। নিভু নিভু আগুনে
দেন পানি ঢেলে। আন্দোলন করবে কাদের জন্য কর্মিরা,
জনগণতো অকৃতজ্ঞ। শুধু ভিতরে থেকে পঁচে মরবে কেন। আর ঐ দিকে “আওয়ামী লীগ তো জুম্মোদের
একমাত্র সহানূভূতিশীল দল”। “জুম্মোদের প্রতি খুব আন্তরিক”। জেএসএস’এর সাধারণ কর্মিদের
মোহাবিষ্ট করতে আওয়ামী লীগের পক্ষে চলতে থাকে জোর প্রচারণা। ভিতরে ভিতরে চলতে থাকে
গোপন দুতিয়ালী। ষড়যন্ত্র আর চক্রান্তে মেতে উঠেন সন্তু লারমা। ধুধুকছড়া হয়ে। উঠে
“কাশিম বাজারের কুঠি”। জীবন বাবুর ভাষায়ই বলি, ‘...ভাবতে অবাক লাগে কী হতে কী হয়ে
গেলো’। বড় দুঃখ হয় জীবন বাবু আমাদেরও। পিসিপি’র চার কেন্দ্রীয় নেতাকে সন্তু লারমা
কমিটি থেকে বাদ দেবার জন্য প্রসিত খীসাদের কাছে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। সেটা ছিলো সম্পূর্ণ
অগণতান্ত্রিক। পিসিপি'র কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে গৃহীত সিদ্ধান্ত প্রসিত খীসারা পাল্টিয়ে
দেননি, দেয়ার কথাও নয়। পিসিপি কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে অগণতান্ত্রিকভাবে হস্তক্ষেপ করে
উক্ত চারজনকে বাদ না দেয়ায় প্রসিত খীসা সন্তু লারমার রোষানলের শিকার হন। আবার আপনাকে
উদ্ধৃত করে বলতে হয়, ‘জুম্মো জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় জেএসএস এর সশস্ত্র বাহিনীতে
যোগ দেয়া যার একমাত্র প্রতিজ্ঞা। ... শান্তিবাহিনী তথা সশস্ত্র সংগ্রামে নিজেকে নিবেদিত
রাখাটাই তখনকার সময়ে যার একমাত্র চাওয়া-পাওয়া’ তার এবং আমাদের কারো পক্ষেই আর তা
সম্ভব হয়নি। হওয়ার কথাও নয়।
প্রসিত খীসারা আন্দোলন বেগবান করে অধিকার আদায়ের জন্য ছাত্র সমাজকে প্রস্তুত করে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। আন্দোলনের নিয়মও সেটাই। স্বাভাবিকভাবে বাইরে দুর্বার আন্দোলন গড়ে উঠতে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় সৃষ্টি হয়। একের পর এক সফল আন্দোলন হতে থাকে। ছাত্র আন্দোলনের জোয়ার সারা পার্বত্য চট্টগ্রামে অনুভূত হয়। জনগণ নতুন করে আশায় বুক বাঁধে। সরকার-সেনাবাহিনীর আতঙ্ক শুরু হয়ে যায়। ছাত্র-যুব সমাজের উপর নেমে আসে নিপীড়ন-নির্যাতনের ষ্টিম রোলার। ধর-পাকড় শুরু হয়ে যায়। মিথ্যা মামলা হুলিয়া ঝুলতে থাকে। আন্দোলন আরো তীব্র আরো জোরদার করে ছাত্র সমাজকে চূড়ান্ত স্তরে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রসিত খীসারা সুনির্দিষ্টভাবে চালিত করতে থাকেন। কিন্তু জাতির বড় দুর্ভাগ্য, সে সময় আন্দোলন গুটিয়ে ফেলে সন্তু লারমা ‘আত্মসমপর্ণবাদী লাইন’ গ্রহণ করেন। ভিতরে যেখানে তিনি জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র আন্দোলন গুটিয়ে ফেলছেন, সেখানে বাইরের উত্তাল আন্দোলন তার নিজের জন্য হুমকি বলে ধরে নেন। বাইরে আন্দোলন তুঙ্গে থাকলে সারেন্ডার করা সহজ নয়। তাই আন্দোলনকারী ছাত্ররা তার কাছে হয়ে দাঁড়ায় আতঙ্কের কারণ। বাইরের উত্তাল আন্দোলন স্তিমিত করে দিতে ঘৃণ্য খেলায় মেতে উঠেন।
ধুধুকছড়ায় ফতোয়া জারি করেন “জঙ্গী আন্দোলন করা যাবে না”। সরকারের সাথে সুর মিলিয়ে বাইরের আন্দোলন সংগ্রামকে সন্তু লারমা প্রকাশ্য জনসভায় সামাজিক “শৃঙ্খলা বিনষ্ট”...আখ্যা দিয়ে লোকজনকে অবাক করে দেন। সরকার সেনাবাহিনীর চর দালাল গণদুশমনদের পক্ষ অবলম্বন করে বক্তব্য দেন। জাতীয় শত্রু সমীরণের মাঝে “দেশপ্রেম” আবিষ্কার করেন। প্রকৃত আন্দোলনকারী সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। ছাত্র পরিষদে ভাঙ্গন ধরাতে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করেন। নানান প্রলোভন দেখিয়ে কিছু বেকার হতাশাগ্রস্ত যুবকও জুটিয়ে নেন। তাদের দিয়ে পিসিপি’তে গন্ডগোল লাগিয়ে দেন। তার কুমন্ত্রণায় পিসিপির কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আর কাউন্সিল কিছু ছাত্র বর্জন করে। চট্টগ্রামে তাদের দিয়ে তিনি পাল্টা প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আর কাউন্সিল করিয়ে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের আন্দোলনের ইতিহাসে কলঙ্ক লেপন করেন। পিসিপি’কে দুর্বল করার সরকার-সেনাবাহিনীর নীল নক্সা সন্তু লারমা বাস্তবায়ন করে দেন। ’৮২ সালে একইভাবে তিনি শান্তিবাহিনীতে বিভক্তি এনেছিলেন। Fearfull State বইয়ের লেখক বর্তমানে বিবিসি বাংলা বিভাগের প্রধান সৈয়দ মাহমুদ আলী যথার্থই মন্তব্য করেন, সরকার যদি শান্তিবাহিনীতে ভাঙ্গন ধরানোর জন্য সন্তু লারমাকে ছেড়ে দিয়ে থাকে, তাহলে বলতে হবে যে সরকার তাতে সফল হয়েছে। বইয়ে লেখক সরকারের কাছে সন্তু লারমার ১৯ পৃষ্ঠা ব্যাপী গোপন লিখিত অঙ্গীকার দেবার কথাও প্রকাশ করেন। সন্তু লারমা আসলে সরকার—সেনাবাহিনীর সাথে আঁতাত করা একটা ট্রোজেন হর্স [ট্রয় নগরীর কাঠের ঘোড়া]। সেনাবাহিনী দিয়ে বাইরে থেকে শত নিপীড়ন-নির্যাতন চালিয়েও আন্দোলন শেষ করে দিতে না পারায়, সরকার সন্তু লারমাকে মুক্তি দিয়ে ট্রোজেন হর্স হিসেবে শান্তিবাহিনীতে ফিট করে দেন। ’৮২ সালে তিনি সরকারের নীল নক্সা মতো শান্তিবাহিনীতে ভাঙ্গন ধরিয়ে সংগঠনকে দুর্বল করে দেন। ’৮৬ সালে পানছড়ি ও দীঘিনালা থেকে জোরজবরদস্তি করে শরণার্থী বানিয়ে সমৃদ্ধ এলাকার জনগণের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙে দেন। জায়গা-জমি সেটলারদের দখল করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেন। আর “জনগণ আন্দোলন বিমুখ” আখ্যা দিয়ে শান্তিবাহিনীর সাধারণ কর্মি আর জনগণের মাঝে সৃষ্টি করেন বিভেদ। পরিকল্পনামতো শান্তিবাহিনীতে ভাঙ্গন আর জনগণের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙে সর্বশান্ত করতে সক্ষম হন। তারপর আসে ছাত্র পরিষদের পালা। ’৯৭ সালের ৩০ জুন আন্দোলনের নতুন শক্তি জনগণের শেষ ভরসাস্থল ঐক্যবদ্ধ ছাত্র পরিষদের মাঝে দুই নাম্বারী ছাত্র পরিষদ সৃষ্টি করে দেন। মূল ছাত্র পরিষদের বিরুদ্ধে দুই নাম্বারী ছাত্র পরিষদ লেলিয়ে দিয়ে গোটা ছাত্র সমাজকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ তথা সারা দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করতে নিজে শান্তির অবতার সেজে যান। পরিকল্পনামতো টেলিভিশন রেডিও-পত্র-পত্রিকায় সন্তু লারমার সপক্ষে শুরু হয়ে যায় জোর প্রচারণা। পরিস্থিতি অনুকূলে আসলে ’৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকারের সাথে লিখিত-অলিখিত চুক্তি করেন। ’৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারী শান্তিবাহিনীতে থাকা এতদিনের ট্রোজেন হর্স বেরিয়ে আসে। সংগ্রামীর মুখোশ খুলে ফেলে পুরোপুরি আসল চেহারা নিয়ে খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে হাজার হাজার দর্শকে সামনে আবির্ভূত হন সন্তু লারমা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, ‘আজ সত্যিই আমার ভীষণ ভালো লাগছে’। (আজকের কাগজ: ১১ ফেব্রুয়ারী ’৯৮) একই দিনের দৈনিক জনকণ্ঠের রিপোর্ট: সন্তু বলেন, ‘আজ আমাদের বাড়ি ফেরার যে পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে তাতে যে ভাল লাগছে তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। বাইশ বছর বয়সে আমি যে আন্দোলন সংগ্রাম শুরু করেছিলাম অসমর্পণের মাধ্যমে তার পরিসমাপ্ত ঘটল’। দৈনিক ইত্তেফাকের রিপোর্ট : কেন অস্ত্র সমর্পণ করিলেন এই প্রশ্নের জবাবে সন্তু লারমা বলেন, ‘এ বিষয়টি সরকার হইতে জানিয়া নিলে ভাল হয়’। পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষের অজান্তে গোপনে সরকারের সাথে তিনি বহু আগেই বোঝাপড়া করে ফেলেছিলেন। জনগণের অধিকার নয়, জাতীয় স্বার্থ ও ভবিষ্যত বিকিয়ে দেয়াই ছিলো তার লক্ষ্য। সেজন্য সারেন্ডার করে তার উপর সরকার কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছিলেন মাত্র। ঐদিনের ভোরের কাগজের রিপোর্ট: মানবাধিকার লঙ্ঘন, লোগাং, নানিয়াচর গণহত্যা, কল্পনা চাকমা অপহরণের বিচার দাবি করবেন কিনা-প্রশ্ন করা হলে সন্তু লারমা এগুলো অনেক বড় জটিল এবং বিতর্কত প্রশ্ন বলে উল্লেখ করে বলেন, এ ব্যাপারে আমাদের কোনো কিছু বলা উচিত নয়। জীবন বাবুর ভাষায় একে বলতে হয়, ‘এ কোন সেলুকাস! নেমক হারাম আর কাকে বলে’।
সন্তু লারমার দর্শন
হচ্ছে “রাজনীতি করলে অভিনয় করতে হয়” আর “ব্লাফ দিতে হয়”। ’৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর আর
’৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে তিনি হাতে কলমে সবাইকে বুঝিয়ে দেন
এত বছর কার সাথে অভিনয় করেছেন, কাদের ব্লাফ দিয়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত পরিকল্পনা মতো
কার কাছে আসল রূপে ধরা দিয়ে কাজ হাসিল করে দিয়েছেন। হায় পৃথিবী! তুমি যাদের কাছে
টাকার গোলাম, যুগে যুগে তুমি তাদের দিয়ে বিভীষণ-মীর জাফর-গোলাম আজম-রাজাকার-আল বদর-কুইসলিং’দের
বেঈমানীর নিষ্ঠুর খেলা খেলে যাও!!! পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকারহারা হতভাগ্য জনতা এই
নিষ্ঠুর খেলার শিকার হয়ে সর্বশান্ত হলো।
জনসংহতি সমিতির হাঁড়ির এতসব খবর জেনে, সন্তু লারমার মতিগতি বুঝে ফেলে কোন দুঃখে প্রসিত খীসারা জনসংহতি সমিতি-শান্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে লেজ কাটা শেয়ালের দশায় পড়তে যাবেন! জনসংহতি সমিতির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা প্রসিত খীসাদের কাছে একান্তে স্বীকার করেন যে, জনসংহতি সমিতির নেতাদের কাউকে দিয়ে সংগঠনকে আর বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে উন্নত করা যাবে না। এমনকি বাইরের ছাত্র-যুবকদের মধ্য থেকেও কোন দক্ষ নেতৃত্ব যুক্ত হলেও জেএসএস’এর পতনকে আর রোধ করা সম্ভব নয়। প্রসিত খীসারা আরো আশ্চর্যের সাথে জানতে পারেন যে, সন্তু লারমা আন্দোলন করতে আর মোটেও আগ্রহী নন। সরকারের কাছ থেকে সাধারণ প্রশাসন চালাবার ক্ষমতা না পেলেও তিনি সারেন্ডার করার জন্য এক পায়ে খাড়া। জনসংহতি সমিতির রাজনৈতিক লাইন-কলা কৌশল সব কিছু পর্যালোচনা করে ’৯৫ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝিতে তিন গণতান্ত্রিক সংগঠন পিজিপি-পিসিপি-এইচডব্লিউএফ নেতৃবৃন্দ এক মিটিঙে এই সিদ্ধান্ত উপনীত হন যে, জেএসএস সরকারের কাছে সারেন্ডার করবে। তাতে জনগণের অধিকার অর্জিত হবে না। আওয়ামী লীগ পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানের কথা বললেও বেঈমানী করবে। জেএসএস ‘আত্মসমর্পণবাদী লাইন’ নিয়েছে। তারা যা কিছু বলুক, তাদের দ্বারা আর আন্দোলন সম্ভব নয়।
আন্দোলন সংগ্রামের ব্যাপারে প্রসিত খীসার দৃঢ়তা আর তার প্রতি ছাত্র-যুব সমাজের আস্থা সম্পর্কে জীবন বাবু নিজেই স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন, ‘সাধারণ ছাত্র-যুব কর্মীরাও মনে করত অন্য কেউ না গেলেও প্রসিত বাবু জেএসএস-এ যোগ দেবেই’। শেষ পর্যন্ত তার এবং আমাদের পক্ষে আর জেএসএস-এ যোগ দেয়া সম্ভব হয়নি, হওয়ার তো কথাও নয়। জীবন বাবু আর সন্তু লারমারা আব্রাহাম লিঙ্কনের বিখ্যাত উক্তি ভুলে গেছেন, ‘কিছু সময়ের জন্য সব মানুষকে বোকা বানিয়ে রাখা যায়, কিন্তু সব মানুষকে সারা জীবন বোকা বানিয়ে রাখা যায় না’। সন্তু লারমার ‘অভিনয়’ আর ‘ব্লাফ’ রাজনীতি কিছু সময়ের জন্য আমাদের বোকা বানিয়েছে সেটা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই। কিন্তু সারা জীবন সবাইকে বোকা বানিরয়ে রাখার খায়েশ পোষণ করে যা সন্তু লারমা করে যাচ্ছেন, তাতে তিনি এখন বোকার স্বর্গে বাস করছেন। তিনি আসলে এতদিন আন্দোলনকারীর ভং ধরে ছিলেন।
সন্তু লারমারা জনগণের জন্য আন্দোলন করছেন মনে করে আমরা কত যে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছি, সেটা আমাদের সমসাময়িক সব ছাত্ররা জানেন। দুর্ভাগ্য জনগণের দুঃখের অবসান হবে সে প্রত্যাশা নিয়েই তো আমরা তা করেছি। শুধু আমরা নই, সাধারণ জনগণও একই আশায় নিজের যা সামর্থ্য আছে তা দিয়ে হৃদয় উজার করে জেএসএস কর্মিদের আপ্যায়ন করতো। কি কি করে দিতো সে সব বয়ান করার রুচি আমার নেই। এতদসত্ত্বেও জেএসএস নেতারা কোন কোন জায়গায় জবরদস্তি করে জনগণের কাছ থেকে ‘আপ্যায়ন’ আদায় করে নিতেন, সেটা কোন বানানো কথা নয়। নিজের চোখে দেখা আর নিজের কানে শোনা ঘটনা। জেএসএসকে আন্দোলনে সহায়তা দিয়ে আমরা বিরাট কিছু করেছি সেটা আমরা কখনোই দাবি করি না। ছাত্র থাকাকালে আমরা অপদার্থ অকর্মণ্য ছিলাম না। দেশ-জাতির সপক্ষে আমরা সাধ্যমতো কাজ করেছি। সংগ্রামের প্রেরণা থেকেই জেএসএসকে সহায়তা দিয়েছি। তার জন্য আমাদের কোন আফসোস নেই। তবে, দুঃখটা এখানে যে, যেটিকে আমরা পার্টি ভেবে মনেপ্রাণে সহায়তা দিয়েছি। অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছি। তাতে শরীক হয়ে লড়াই সংগ্রামে আত্মনিবেদন করার মনস্থ করেছি। তা আসলে পার্টি নয়, একটা সমিতি মাত্র। তারা আন্দোলন করতে চায় না। থাকতে চায় প্রাইভেট কোম্পানীর মতো। বড় দুঃখ হয়, নিজেদের এতদিনের পরিশ্রম বিফলে গেছে দেখে। তবে, আমাদের স্বপ্ন কেউ কেড়ে নিতে পারেনি, পারবেও না। অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বুকে নিয়ে আমরা নতুন পার্টি ইউপিডিএফ গড়ে তুলেছি। পথভ্রষ্ট জেএসএস’এর সাথে গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে গিয়ে লাম্পট্য আর নষ্টামি করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। মাটিতে ফেলা থু থু তুলে নিয়ে সন্তু লারমা-জীবন বাবুরা কপালে তিলক আঁকতে পারলেও, তা আমরা পারি না। যুগে যুগে শুধু বিভীষণ, গোলাম আজম-রাজাকাররা জন্ম নিয়ে ইতিহাস কলঙ্কিত করে না, তার বিপরীতে মুক্তিযোদ্ধা জন্মায়। তারাই জাতির অপমানের শোধ নেয়, করে জাতির ইতিহাস পৌরবোজ্জ্বল। তাই যুগে যুগে দিয়েমের বিপরীতে হেচি মিন-গিয়াপ’রা, পূর্ব তিমুরে ইন্দোনেশিয়ার সেনা মদদপুষ্ট মিলিশিয়াদের বিপরীতে স্বাধীনতাপন্থী সংগ্রামীরা জন্মান। প্রতিক্রিয়াশীলের বিপরীতে প্রগতিশীল, লম্পটের বিপরীতে সৎ, আপোষকামীর বিপরীতে প্রতিবাদী, বেঈমান-বিশ্বাসঘাতকের বিপরীতে সংগ্রামী আত্মোৎসর্গকারী, আর কাপুরুষের বিপরীতে জন্মান সাহসী বীর। পৃথিবীতে শুধু দালালীর দৌরাত্ম্য নেই, সংগ্রামী বিপ্লবীদের বিজয়ও আছে। শুধু বেঈমান বিশ্বাসঘাতকের আত্মসমর্পণ নেই, তার বিপরীতে আছে অধিকার প্রতিষ্ঠার দুনিয়া কাঁপানো সাহসী লড়াই। পৃথিবীতে দমন-পীড়ন-হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে, দাঙ্গা বাঁধিয়ে দিয়ে, দালাল-বেঈমান লেলিয়ে দিয়ে কোন অধিকারকামী জাতির আন্দোলন ধ্বংস করা যায়নি। তার অতি সা¤প্রতিক দৃষ্টান্ত পূর্ব তিমুর। ইন্দোনেশিয়া অর্থ-অস্ত্র সবকিছু দিয়েও মিলিশিয়াদের দিয়ে পূর্ব তিমুর জনগণের সংগ্রাম স্তব্দ করে দিতে পারেনি। ঘরের দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ। পশ্চিম পাকিস্তানীরা ট্যাংক-কামান-মেশিনগান অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে আর রাজাকার-আল বদর লেলিয়ে দিয়েও বাংলাদেশের জনগণকে পরাস্ত করতে পারেনি। দৃষ্টান্ত এখানে শেষ নয়, ভিয়েতনাম, নামিবিয়া, দঃ আফ্রিকা, আলজেরিয়া... আছে আরো অনেক। একটা জাতির জীবনে শুধু অমাবস্যার ঘোর অন্ধকার নেই, আছে পূর্ণিমার উজ্জ্বল আলোও।
যারা পেঁচার মতো তারাই
শুধু খোঁজে অন্ধকার। যারা বিপ্লবী তারা সন্ধান করে আলোর। পথ বেছে নেয় মুক্তির। করে
সংগ্রাম। যারা বেঈমান-বিশ্বাসঘাতক-দালাল তারাই কেবল জাতির দুঃসময়ের অপেক্ষায় ঘাপটি
মেরে থাকে। দেশ-জাতি দুঃসময়ে হাসিল করে ব্যক্তিস্বার্থ, যেমন করে থাকে চোরেরা। বাজারে
গ্রামে আগুন লাগলে সাধারণ মানুষের হয় দুর্ভোগ, চোরদের হয় মহাসুযোগ। সমাজ-জাতির সর্বনাশ
হলে, দালাল-বেঈমানদের জন্য তা হয় আশীর্বাদ।
জীবন বাবু ভাবভঙ্গী দেখিয়ে গালভরা শব্দ ‘দলীয় বাস্তবতা’ উচ্চারণ করেছেন, তার ব্যাখ্যা দেননি। কদর্যভাবে ব্যক্তি আক্রমণ করে বিষেদাগার করেছেন। তাদের রাজনৈতিক লেভেল হচ্ছে ততটুকু পর্যন্ত।
জেএসএস’এর দলীয় বাস্তবতা জীবন বাবুরা নিজেরাই বুঝেন না, আগেও বুঝেননি। এখানো না। এখানেই তাদের যত গন্ডগোল। সাধারণ জনগণকে ভড়কে দেবার জন্য বাগাড়ম্বরপূর্ণ শব্দ বোমা ফাটান মাত্র। যার অর্থ ও ব্যঞ্জনা তারা নিজেরাই বুঝেন না। সাধারণ জনগণকে আরো ধোঁকা দেয়ার মতলবে এসব তারা বলেন। চুক্তি ও সারেন্ডার করে একবার তো বড় ধরনের ধোঁকা দিতে পেরেছে, এবার আরো সুর আর কৌশল পাল্টিয়ে নতুন কায়দায় ধোঁকা দেয়ার ফন্দি আঁতছে। ব্লাফ দিতে হয় তো! অভিনয় তো করতে হয়!
তাদের দলীয় বাস্তবতা হচ্ছে আসলে এই, তাদের এক সময় সব কিছু ছিল, এখন নেই সে সব কিছু। সব কিছু দিয়ে জেএসএস অধিকার আদায় করতে পারেনি, এখন বহু কিছু না থাকায় তাদের পক্ষে আর আন্দোলন করা সম্ভব নয়। অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা তো বাদ। সে কথা অবশ্য তারা আর মুখেও আনেন না। তা তারা পারবেনও না। জনগণও বিশ্বাস করে না। তাই বলেন শুধু চুক্তি বাস্তবায়নের কথা।
তারা আন্দোলন করার ফাঁকা আওয়াজ তোলেন, কিন্তু বাস্তবে যেটা করছেন সেটা হচ্ছে দালালি। ভবিষ্যত চিন্তা করে সেটা সন্তু লারমা ধুধুকছড়াতে বসেই দালালদের সাথে দহরম-মহরম করে দালালীগিরির তালিম নিয়েছেন। দালালি প্রতিভাও তার রয়েছে। তা বিকাশের পরিবেশ পেয়ে দ্রুত রপ্ত করে ফেলেছন। বিএনপি নেতা খালেকের চাইতে তার প্রতিভা কোন অংশে কম নয়। সকালে ফুলের তোড়া নিয়ে হাস্যোজ্জ্বল ছবি তুলে, সন্ধ্যায় কান্নাকাটি করে ভেঙে পড়তে পারেন। যার প্রতিভা যেদিকে, তাকে ঠেকায় কে!! ফুটবল স¤্রাট পেলে বস্তি থেকে উঠে এসেছেন। বস্তি জীবন তার ফুটবল প্রতিভা ঢেকে রাখতে পারেনি। সন্তু লারমার আছে দালালি প্রতিভা, তাকে সংগ্রামী বিপ্লবী বানাবার সাধ্য কার!!! প্রসিত খীসারা ভিতরের সমর্থনে বাইরে আন্দোলন তুঙ্গে তুলতে গিয়েই তো চিড়া ভিজিয়েছেন! দালালির পথে বাধ সাধতে গিয়ে সন্তু লারমার রোষানলে পড়েন। হিট লিষ্টে উঠে যান। কি দুঃসাহস তাদের জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়!! মজা বুঝবে তারা!! আর্মি-পুলিশ-দালাল-স্পাই-মুখোশ-আওয়ামী লীগ সরকার সবকিছুই তার সাথে। এখন তো পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্তু লারমাই দালালদের শীর্ষে। প্রসিত খীসারা তাকে বাধা দিতে চাচ্ছিলেন! কি স্পর্ধা তাদের!!! সন্তু লারমার উন্নতি তারা সহ্য করতে পারছিল না। ব্যক্তিগত শত্রুতা আছে তাদের সাথে। গোলাম আজমদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদেরও বোধহয় স্রেফ ব্যক্তি শক্রতা ছিলো। সন্তু লারমা হেলিকপ্টারে চড়ুক, তা প্রসিত খীসারা চায় না, ঈর্ষা করে বোধ হয়। সরকারের কাছে এখন কত কদর সন্তু লারমার!! এটা তারা হতে দিচ্ছিল না! দালালি করেই তিনি দালালদের হঠিয়ে দিচ্ছেন! এটাই হচ্ছে সন্তু লারমার ‘কৌশল’ ‘কূটনীতি'’। প্রসিত খীসারা বুঝে না! খোলা চিঠি দিয়ে তাদের আচ্ছা মতো জ্ঞান দিয়েছি। পূর্ণস্বায়ত্তশাসন দাবি নিয়ে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে। জীবন বাবুদের মনোভাব হচ্ছে এটাই।
এত বাস্তবতা বাস্তবতা বলেন, দেখি আপনাদের বাস্তবতার ঝাপি খুলে। কি কি ছিলো জেএসএস’এর- এক সময় পুরো ফিল্ড তাদের। ’৮৫ সালে প্রীতি গ্রুপ সারেন্ডার করে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। ভিতরে শান্তিবাহিনী। হাতে অস্ত্র। সাথে জনগণ। পেছনে বিদেশের সমর্থন আশ্রয়। দর কষাকষির শরণার্থী ইস্যু। ছিলো বাইরে প্রচারণা। তাছাড়া আমাদের ছাত্র পরিষদ, গণপরিষদ, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের জোরালো সমর্থন। হিল লিটারেচার ফোরামের প্রকাশনা। দেশে লেখক-বুদ্ধিজীবী-ছাত্র-শিক্ষকসহ প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর এক ব্যাপক অংশের সমর্থন।
আর এখন অবস্থা— হাতের অস্ত্র সেনাবাহিনীর কাছে। শান্তিবাহিনী বিলুপ্ত। শরণার্থীরা দেশে প্রত্যাগত, প্রতারিত। চুক্তির ব্যর্থতা উন্মোচিত। জেএসএস’এর প্রতি জনগণের আস্থা নেই। সন্তু লারমা জাতীয় বেঈমান হিসেবে চিহ্নিত। পুলিশ-সেনা প্রহরা ছাড়া সন্তু লারমা বেরুতে পারেন না। নিরাপত্তাহীতায় ভুগেন সারাক্ষণ। গ্রামে যেতে পারে না তার সাগরেদরা। তাদের পেছনে নেই সেই আগের বিদেশের আশ্রয়-সমর্থন। নেই বাইরের মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সহানুভূতি। নেই পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ-গণপরিষদ-হিল উইমেন্স ফেডারেশন। নেই স্বাধিকার প্রকাশনার সমর্থন। আগের লেখক-বুদ্ধিজীবী-এর সমর্থন ছাত্র-শিক্ষক-সাংবাদিক-রাজনীতিবিদদেরও জেএসএস’এর প্রতি সমর্থন নেই। যারা এখন জেএসএস’এর সাথে জুটেছে, তারা সবাই নতুন। দুঃসময়ে তাদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ দেখিনি। তাদের দেশের সচেতন নাগরিগণ কি হিসেবে বিবেচনা করেন তা না বলাই ভালো।
আগে গোটা ফিল্ড ছিলো জেএসএস'এর, এখন দাঁড়িয়ে গেছে ইউপিডিএফ। এত বছর ধরে জেএসএস সবকিছু পেয়েও সারেন্ডার করেছে। আর এখন সবকিছু হারিয়ে কেবল আওয়ামী লীগের সমর্থন আর সহায়তা নিয়ে কি করতে পারবে সে সন্দেহ জনমনে প্রবল। যে আওয়ামী লীগকে বিশ্বাস করে তারা সবকিছু বিকিয়ে দিয়ে সারেন্ডার করেছে, সেই আওয়ামী লীগ তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। জীবন বাবুর ভাষায় “আধাআধি স্বায়ত্তশাসন”ও আর বাস্তবায়ন করছে না। ধূর্ত শেয়ালের মতো আওয়ামী লীগ সরকার তো চুক্তি আর সারেন্ডার করাতে পেরেই তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করে ফেলেছে। জেএসএস এখন চুক্তি ও আঞ্চলিক পরিষদের জালে আটকা পড়ে গেছে। তাকে নিয়ে সরকারের চিন্তা বা উদ্বেগের কোন কারণ নেই। চিন্তা হচ্ছে নতুন পার্টি ইউপিডিএফ’কে নিয়ে। তাকে দুর্বল আর ধরাশায়ী করার জন্য সরকার জেএসএস’কে গুটি হিসেবে ব্যবহার করছে। পূর্ব তিমুরে ইন্দোনেশিয়ার সেনাবাহিনী স্বাধীনতাপন্থী আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে যেভাবে মিলিশিয়াদের, পশ্চিম পাকিস্তানিরা যেভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে রাজাকার-আলবদরদের ব্যবহার করেছে, বর্তমান সরকারও ঠিক তেমনি জেএসএস’কে ইউপিডিএফ’এর বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। তার জাজ্বল্য দৃষ্টান্ত হচ্ছে গত বছর ২৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম লালদীঘিতে আহুত ইউপিডিএফ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, ২২ অক্টোবর খাগড়াছড়ির চেঙ্গী স্কোয়ারে দীঘিনালা বাবুছড়া ঘটনার প্রতিবাদে আহুত ইউপিডিএফ’এর প্রতিবাদ সভা আর ২২ এপ্রিল খাগড়াছড়ির খেজুর বাগান মাঠে আহুত পিজিপি ও এইচডব্লিউএফএর যৌথ কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সম্মেলন সরকার সন্তু লারমাকে দিয়ে ভণ্ডুল করে দেয়। এ বছর ২০ মে খাগড়াছড়িতে আহুত পিসিপি'র প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান বানচাল করে দিতে সন্তু চক্র-প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করায়। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের যেখানে যেখানে ইউপিডিএফ’এর শক্ত গণভিত্তি রয়েছে এবং কার্যক্রম চলছে, সে সব এলাকায় সন্তু লারমা সেনাবাহিনীর সহায়তায় সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের দিয়ে সাধারণ জনগণের উপর আক্রমণ চালাচ্ছে। খাগড়াছড়ির শিবমন্দির এলাকায় দোকানপাট-পাড়াগ্রাম পুড়িয়ে দেয়া, জমিতে ধান রোপন করতে ব্যস্ত লোকের উপর নির্বিচার গুলি বর্ষণ... এ ধরনের বর্বরোচিত ঘটনা সন্তু চক্র প্রায় জায়গাই ঘটাচ্ছে। এই তালিকা বেশ দীর্ঘ। ‘জুম্মো দিয়ে জুম্মো ধ্বংস করা’ই হচ্ছে সরকারের নীল নক্সা। এই নীল নক্সা বাস্তবায়নের জন্য এখন সরকারের মোক্ষম হাতিয়ার হচ্ছে সন্তু লারমা চক্র। ’৮৯ সালে জেলা পরিষদের গণদুশমন সমীরণরা সমাজ অনিষ্ট করতে যে ঘৃণ্য কর্মকান্ড পরিচালনা করেছিলো, আঞ্চলিক পরিষদের গদিতে বসে সন্তু লারমা তার চাইতেও জঘন্য ভয়াবহ ধ্বংসাত্মক কাজে নেমেছে। ’৮৯-এর জেলা পরিষদ নাটকের পুনঃঅভিনয় চলছে মাত্র। তবে এবারের যাত্রা—তামাশায় সন্তু—সমীরণ দু’জনেই সরকারের গুটি। সন্তু লারমাই এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের সব দালালদের প্রতিনিধি। তিনি হচ্ছেন এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের গোলাম আজম। সমীরণ-ভূবনকে দিয়ে সরকার যা করতে পারেনি, সন্তু লারমা চক্রকে আঞ্চলিক পরিষদে বাগিয়ে নিয়ে তাই করতে সক্ষম হচ্ছে।
শ্রী পেলের ভাষায় এ অবস্থাকে ব্যাখ্যা করলে তবেই মানানসই হবে, ‘...বিভেদপন্থী হোতাদের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হচ্ছে আমৃত্যু প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে যাওয়া। এদের ষড়যন্ত্রের শেষ নেই। তারা নিজের নাক কেটে হলেও অপরের যাত্রা ভঙ্গ করতে সঙ্কল্পবদ্ধ। প্রয়োজনে নতজানু হতে দ্বিধা করে না—আবার সুযোগে পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খেতেও ওস্তাদ। তাই কখনও “রাখে আল্লা মারে কে” আবার কখনও “রাখে হরি মারে কে”--এই সব সুবিধাবাদী পন্থায় চার কুচক্রীরা নিমগ্ন রয়েছে, তাদের চেহারা দেখতে ঠিক মৃত বানর মত হলেও এখনও একদিকে সরকারের দালালী ও লেজুড়বৃত্তি অন্যদিকে কুটনৈতিক ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। নিজেদের হীন ব্যক্তি স্বার্থের কারণে তারা অতীতে যেমন ষড়যন্ত্র করেছিল, বর্তমানেও করে যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও তাই করবে। তাদের এই চরিত্র মজ্জাগত। অবশ্য এই খোলসটি উন্মোচিত হয়ে পড়লে তারাও বিদেশের চিড়িয়াখানায় অস্ট্রেলিয়ান ক্যাঙ্গারুর মত প্রদর্শন যোগ্য হয়ে পড়বে। (দেখুন: ১০ নভেম্বর ৮৩ স্মরণে, ১৯৮৫ সংকলন, পৃষ্ঠা— ৭)।
প্রয়াত মানবেন্দ্র
নারায়ন লারমার উদ্দেশ্যে দেয়া খোলা চিঠিতে জেএসএস’এর ভিতরের অবস্থা প্রকাশ পেয়েছে,
“...আপনার শিষ্যদের কেউ কেউ অত্যন্ত লোভী হয়ে পড়েছে। ...সংগ্রামের পথ পরিহার করে
ব্যক্তি ভোগ লালসায় মনযোগ দিচ্ছে। ... আপনার কিছু কিছু কর্মি আছে তারা অত্যন্ত হাতাশায়
ভুগছে। অনেকে আবার অত্যন্ত স্বার্থপর হয়ে পড়েছে। প্রয়াত লারমার প্রধান ‘সিপাহী
শালার’ সন্তু লারমাই এখন একই দোষে দুষ্ট নীতি-আদর্শহারা, পথভ্রষ্ট, দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি-লাম্পট্য-নষ্টামী
সব দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত।
এরপরেও প্রয়াত লারমাকে ব্লাফ দিচ্ছেন, ‘কাজেই ভয়ের কিছু নেই। চুক্তি বিরোধীরা ক্রমেই জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে...। ...বিজয় আপনার হবে এ ব্যাপারে জনগণ নিশ্চিত’।
বাস্তবতা হচ্ছে, আগে এত কিছু থেকেও জেএসএস চুক্তি ও সারেন্ডার করেছে। এখন নিজেরাই স্বীকার করছেন জেএসএস কর্মিরা লোভী, সংগ্রামের পথ পরিহার করেছে, ভোগ লালসায় মনযোগ দিচ্ছে, হতাশায় ভুগছে, স্বার্থপর হয়েছে। লোকে এগুলো জানে, এখন আপনারা নিজেরা স্বীকার করলেন। যেটা এখনো স্বীকার করেননি তা হচ্ছে, আপনাদের সাথে মুখোশ, চোর-ডাকাত, ফেনসিডিল-গাঁজা-হিরোইন খোর, জুয়ারী, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ জুটেছে। সন্তু লারমা এদের দিয়ে পুরানো কর্মসূচিতে ফিরে যাবার অঙ্গভঙ্গী করেন! মানে তারা আবার সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করবে! এমন ভাবসাব! এটা তাদের সাধারণ কর্মি আর জনগণকে ব্লাফ দেয়া ছাড়া কিছু নয়। এখানে সবার জানার জন্য খোলাসা করে বলা দরকার যে, সেটা সন্তু লারমার পক্ষে আর সম্ভব নয়। সময় বদলে গেছে। প্রেক্ষাপট পরিবর্তিত হয়েছে। আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ার ছেড়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের কোন এলাকায় আত্মগোপন করে সশস্ত্র সংগ্রাম অংশ নেয়া অন্য কারো পক্ষে সম্ভব হলেও, সন্তু লারমার পক্ষে তা সম্ভব নয়। প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নিয়ে সন্তু লারমার আবার সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু ও পরিচালনা করা সেটা কল্পনা বিলাসীদের কল্পনার জগতে সম্ভব হলেও, বাস্তবে তা সম্ভব নয়। একজন সারেন্ডার করা নেতাকে আবার নিজ দেশে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু ও পরিচালনা করতে দিয়ে আন্তর্জাতিক দুর্নামের ভাগীদার হবার ঝুঁকি কোন প্রতিবেশী দেশ নেবে না।
বাস্তবতার দোহাই দেন,
বাস্তবতা হচ্ছে এটাই— সন্তু লারমাকে গণদুশমন সমীরণের মতো যে সরকার ক্ষমতায় আসে, সেই
সরকারের আশীর্বাদ, করুণা, অশ্রয়-প্রশ্রয় নিয়ে থাকতে হবে। দীপঙ্কর-কল্পরঞ্জন-বীর
বাহাদুরদের সাথে স্বার্থ-ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রশ্নে মনোমালিন্য থাকলেও সন্তু লারমাকে
তাদের সাথেই তাকে উঠা বসা করতে হবে মাঝখানে মরবে শুধু নিবেদিত প্রাণ সাধারণ কর্মিরা।
এখনো তাদের মাসের খোরাক রেশনের টাকা কেটে নিয়ে সন্তু লারমা সন্ত্রাসী মস্তান পুষছেন।
পুরানো কর্মিদের সবার পক্ষে লাম্পট্য-দালালি-নষ্টামী করা সম্ভব হবে না, সেটা তারা পারবেনও
না। যাদের মনুষ্যত্বের তেজ আছে, সে সমস্ত দেশপ্রেমিকরা নয়াযুগের পার্টি ইউপিডিএফ-এর
সাথে যোগ দেবে। এটা কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র। জেএসএস ক্ষমতাসীন সরকারের বি-টিম হয়েই
থাকতে পারবে শুধু।
জীবন বাবু এটাই হচ্ছে জনসংহতি সমিতির এখনকার দলীয় বাস্তবতা।
জীবন বাবু নিজের স্বীকার করেছেন, ‘মূলতঃ জেএসএস-এর যে রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক যোগ্যতা তার (প্রসিত খীসার) মনপুতঃ হয়নি কোন কালে। তার ধারণা হচ্ছে জেএসএস এর চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির যে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ তাও বাস্তব বিবর্জিত’। এ কথাটির আর কোন মন্তব্য প্রয়োজন নেই।
জীবন বাবু চিহ্নিত বাকী
কারণগুলো দেখি।
(২) সাধারণভাবে জুম্ম জনগণের দীর্ঘদিনের সংগ্রামে অবসাদগ্রস্ততা: পয়েন্ট উল্লেখ আছে, কোন আলোচনা নেই। জনগণের অবসাদ কোন কোন ক্ষেত্রে সে সবের কোন ব্যাখ্যা নেই। এখানে বেশী কথা না বাড়িয়ে একটা ঘটনা স্মরণ করিয়ে দেবো। চুক্তি ও সারেন্ডারের কাছাকাছি সময়ে বিবিসি ঢাকা ব্যুরো চীফ ফ্রান্সিস হ্যারিসন পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন। সে সময় সেনাবাহিনীর প্রধান মাহবুবুর রহমান রাঙামাটিতে গিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, সেনাবাহিনী রণক্লান্ত। ফ্রান্সিস হ্যারিসন দীঘিনালাসহ বিভিন্ন এলাকায় মানুষের সাথে কথা বলে এটা মন্তব্য করেন যে, সেনাবাহিনী রণক্লান্ত হলেও পাহাড়ি জনগণ আন্দোলন সংগ্রামে ক্লান্ত নন। নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করার জন্য জনগণকে দোষ দেন কেন? জীবন বাবু খোলা চিঠির এক জায়গায় লিখছেন ‘তবে এই কথা ধ্রুব সত্য যে, জুম্ম জনগণের আন্দোলন করার যে মাত্রায় ত্যাগের মানসিকতা সেই মাত্রা দিয়ে এই আঞ্চলিক পরিষদ পাওয়া যায় মাত্র। এর বেশি আশা করা বৃথা।’ কথাটি এভাবে বললে মানানসই হবে, জেএসএস নেতৃত্ব যে গতিতে পথভ্রষ্ট হয়েছে আর যে মাত্রায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল, সে নেতৃত্বের মান দিয়ে বড় জোর আঞ্চলিক পরিষদ পাওয়া যায় মাত্র। তার বাইরে বেশী কিছু নয়।
(৩) ছাত্র-যুবকদের আন্ডারগ্রাউন্ডে সংগ্রাম করার অনীহা এবং রাজপথের আন্দোলনে মোহগ্রস্থতা: যে ছাত্র-যুব সমাজ অন্যায় ১৪৪ ধারা লংঘন করে ফেরারী জীবন বেছে নেয়, যারা অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিলো, তাদের নামে এত মিথ্যা অপবাদ!! জেএসএস’এ যোগ দিয়ে সেখানে কি করতো তারা, সন্তু লারমাকে সবিনয়ে জিজ্ঞেস করি। যুদ্ধ বিরতি বার বার বাড়িয়ে জেএসএস নেতা-কর্মিরা নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিল তখন। সামরিক ফ্রন্ট না হয় বন্ধ ছিলো। অর্থ কালেকশন ছাড়া আপনাদের আর কোন ফ্রন্টে কাজ হয়েছে? তখন না ছিলো আপনাদের প্রকাশনা, না সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের কাজ, না রাজনৈতিক আলোচনা, না সামরিক ট্রেনিং। খেয়ে-দেয়ে নিশ্চিতে একটা দু-ব্যান্ড রেডিও কোলে নিয়ে বাণিজ্যিক ফিল্মে অনুরোধের আসর শোনার জন্য নব ঘুরানো, শিলং-কাছাড়-অল ইন্ডিয়াা রেডিও সেন্টারের গান শুনতে চোখ বুঁজে নিঝুম নিদ্রায় মগ্ন হওয়া ছাড়া জেএসএস কর্মিদের আর কি কাজ ছিলো? অলস দুপুরে খোশ গল্পে মেতে থাকা, এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে বর যাত্রীর বেশে বেড়ানোর চাইতে একজন উচ্ছল তরুণের কাছে বাইরের উত্তাল আন্দোলন তাকে আকর্ষণ করবেই। সে আন্দোলন যদি আল্ডার গ্রাউন্ডে হতো, সেটাই তাদের আকর্ষণ করতো। সে আন্দোলন যত ঝুঁকিপূর্ণ হোক তা ফুটন্ত রক্তের তরুণ-যুবকদের টানতোই। এটাই ধর্ম। কিন্তু জেএসএস তো তখন বদ্ধ জলাশয়, ধুরন্ধর রাজনীতির পঙ্কিল পাঁকে আটকে যায়। তখন শুধু বাইরের যুবসমাজ নয়, আন্ডার গ্রাউন্ডে কাজ না থাকায় শান্তিবাহিনীর অনেক টগবগে তরুণও মিটিঙ-মিছিলে যোগ দিতে এসেছে। এ স্মরণীয় মুহুর্তগুলো সেই বন্ধুদের নিশ্চয়ই মনে থাকবে। ভ্রান্ত রাজনীতির ফাঁদে পড়ে বেচারাদের অনেককে পলে পলে দগ্ধ হতে হচ্ছে। সেদিন তারা যেমন অলস দুপুরে ঝিমিয়ে না থেকে তারুণ্যের মিছিল—মিটিংয়ে ছুটে এসেছিলেন, সামনে আরো দিন আসছে তারা আবার ছুটে আসবেন। সমস্ত ছলচাতুরী ভন্ডামী লাম্পট্যের মুখোশ ছিড়ে ফেলে তারা মিলিত হবেন অজস্র ছাত্র-যুব০জনতার মুক্তির সংগ্রামে। তখন সন্তু লারমার হাঁকডাক আর কাজ হবে না।
(৪) দেশের রাজনৈতিক ও পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি এবং (৫) প্রতিবেশী দেশ ভারত ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের সার্বিক পরিস্থিতি-- এই দুটো কারণ চিহ্নিত করেই জীবন বাবু খালাশ। বাগাড়ম্বরের জন্য জীবন বাবু বলেছেন আন্তর্জাতিক বিশ্বের সার্বিক পরিস্থিতি। সম্মানিত পাঠক দেখুন ‘আন্তর্জাতিক বিশ্বের’ কথাটি। মন্তব্য করে কথা বাড়াবার ইচ্ছে নেই। এ সব বিষয় নিয়ে যদি কাগজ-কালি খরচ করতে হয়, আর কি-ই আলোচনা হবে? তার ভাষায়, '... লিডিং পাঁচটি কারণের তিনটি আলোচ্য। শেষের দুটি কারণ ব্যাখ্যা করার ধারে কাছে ঘেঁষার সাহস আর কুলায়নি। প্রথম তিনটি কারণ থেকেও দু'টি কারণ আলোচনায়ও আনেননি। প্রথম কারণটি আলোচনাতে বেশ নাটকেপনা ভঙ্গীমা করলেও খেই হারিয়ে কি বলতে কি বলে ফেলেছেন, নিজেও ঠাহর করতে পারেননি।
জীবন বাবু আপনাদের নিজেদের চিহ্নিত শেষের দুটি কারণ সম্পর্কে আরো অনেক তথ্য ও বিশ্লেষণ দেয়া যেতো। তা করতে গেলে আমাদের একটা বই লিখে ফেলতে হয়। বুলেটিনের মতো স্বল্প পরিসরে সব কিছু লেখার সুযোগ নেই। তবে, জীবন বাবু যে দু’টি কারণ চিহ্নিত করেছেন, সেগুলো আলোচনা হলে জেএসএস’এর কর্মিরা আর কতদিন চুক্তি-আঞ্চলিক পরিষদের ভরসায় থাকতে পারবে, তার সন্দেহ আছে।
রাজনৈতিক বিতর্কে অবতীর্ণ হতে চাইলে জীবন বাবু দয়া করে নিয়মকানুন শিখে নেবেন। এত স্বল্প পুঁজি নিয়ে কেন যে মাঠে নামেন?! নাপিতের বাটি নিয়ে সমুদ্রের পানি তুলতে যেতে চান!! রাজনৈতিক বিতর্ক করতে চাইলে রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আসুন, স্বাগত জানাবো। ‘কেবল মনের ঝাল মেটাতে’ যদি চান, তাহলে আপনাদের সাথে কি আলোচনা হবে। আপনারা রাজনৈতিক বিতর্ককে অত্যন্ত নীচে নামান। গ্রাম্য ঝগড়াঝাটির কদর্যতায় ডুবে যান। সে সব আমাদের রুচিতে বাধে। আমরা নোংরা-কাদানর্দমায় পা ডুবাতেও ঘৃণা করি।
শেষে লেখক আহম্মদ ছফা জাসদ দলটির ব্যাপারে যে মন্তব্য করেছেন তা দিয়েই যবনিকা টানতে চাই। যে মন্তব্যটি জেএসএস’এর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। নামের দিক থেকেও রয়েছে সাযুজ্য। আহম্মদ ছফার মন্তব্যের কেবল তিনটি শব্দ পাল্টিয়ে পড়তে হবে। ‘বাংলাদেশের জনগণের গা গরম করার জন্য জাসদ নামের নাটকটি অভিনয়ের আয়োজন করে তারা রাজা উজিরের ভূমিকায় পাকা অভিনয় শিখে ফেলেছেন। অন্য কোন যাত্রাদলের অধিকারী ইচ্ছা করলে ভাড়াটে হিসেবে এদের বায়না করতে পারেন।’ এখানে ‘বাংলাদেশের’ জায়গায় ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম’, রাজা-উজিরের জায়গায় ‘সশস্ত্র গেরিলার’ শব্দগুলো জুড়ে দিতে হবে।
যাত্রা সাঙ্গ হলে পেন্ডেলের
বেড়া-খুটি-শণ যেভাবে যাত্রাদল ফেলে চলে যায়, আর অভিনেতারা নতুন কাজ নেয়। সন্তু লারমা
চক্রও সরকারের সাথে আঁতাত করে আন্দোলন গুটিয়ে নিবেদিতপ্রাণ ত্যাগী কর্মিদের অকূল দরিয়ায়
ফেলে দিয়ে আঞ্চলিক পরিষদে উঠেছে।#
* ৩য় পর্ব দেখতে ক্লিক করুন এখানে
* ২য় পর্ব দেখতে ক্লিক করুন এখানে
* ১ম পর্ব দেখতে ক্লিক করুন এখানে
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।