সচিব চাকমা, আহ্বায়ক, কেন্দ্রীয় পুনর্গঠন কমিটি, পাহাড়ি গণ পরিষদ
[লেখাটি ২০০১ সালের ১ জানুয়ারি স্বাধিকার বুলেটিনের ১৭তম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিলো। সিএইচটি নিউজের পাঠকদের জন্য এই লেখাটি ধারাবাহিকভাবে এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হচ্ছে।] (আজ ২য় পর্ব )
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
৩. পূর্ণস্বায়ত্তশাসন প্রসঙ্গ: কোন মন্তব্য করার আগে জীবন বাবুর কথামালা সাজিয়ে
দেখা যাক কি উদ্ধার করা যায়। জীবন বাবু লিখেছেন :
(১) "... পূর্ণস্বায়ত্তশাসন
কেন স্বাধীনতাই বা কে না চায়।
(২) ... যদিও আজো জানি না সেই পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের
মানেটা কী।
(৩) ...পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের রঙিন
ফানুস উড়িয়ে জনগণকে নূতন স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। পূর্ণস্বায়ত্তশাসন নয়, স্বাধীনতার মোহে
থাকলেও কারোর কোন ক্ষতি বা আপত্তি নেই।
(৪) ...সে যাই হোক, মনে করতে হবে
তার (প্রসিত খীসার) পূর্ণস্বায়ত্তশাসন মানে জেএসএস-এর পাঁচ দফা। ... সেটা যদি নতুন
কিছু হয়ে থাকে তাও আমাদের জানা দরকার। তার বাস্তবতা কী তা জানলেও ক্ষতি নেই।
(৫) ... সেই অধিকারের কথিত পূর্ণস্বায়ত্তশাসনও
হতে পারে যদিও আজো জানি না সেই পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের মানেটা কী।
(৬) ... মানুষ আশা নিয়েই তো বাঁচে।
পূর্ণস্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতে ক্ষতিই বা কি। আমরাও মনে প্রাণে সেই স্বপ্ন
দেখতে কিংবা তারও বেশি আশা করি। জেএসএসও নিশ্চয় পূর্ণস্বায়ত্তশাসন (তা যদি আঞ্চলিক
পরিষদ থেকে সামান্যতম বেশি কিছু হয়) পেলে না করবে না।
(৭) ... প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর সময়ে
তোমার পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের (নয়া রূপকথার গল্প) ডাকের জেরে ব্যাপক অহেতুক আঘাত..
(৮) ... প্রসিত বাবুরা নাকি গণতান্ত্রিক
বিপ্লবী জোট নাকি যেন একটা আছে তার থেকে পূর্ণস্বায়ত্তশাসন কামনা করেন। ভাবতে রীতিমতো
হাসি পায়। অবশ্য সেই দুরাশা প্রসিত বাবুরা করবে না বলেই বিশ্বাস।
পূর্ণস্বায়ত্তশাসন সম্পর্কে এই হচ্ছে
জীবন বাবুর জ্ঞানগর্ব আলোচনা! তা এতই গোলমেলে যে এ থেকে সারবস্তু বের করাই কঠিন। একদিকে
তিনি পূর্ণস্বায়ত্তশাসনকে “রঙিন ফানুস” “নয়া রূপকথার গল্প” বলে কটাক্ষ করছেন। আবার
অন্যদিকে বুঝাতে চাচ্ছেন “পূর্ণস্বায়ত্তশাসন” প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতে ক্ষতি নেই। তারাও
মনে প্রাণে “পূর্ণস্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতে চান”। ডিগবাজী খেয়ে বলছেন
“পূর্ণস্বায়ত্তশাসন” মনে কী জানেন না। স্ববিরোধী কথা বলছেন “প্রসিত খীসার পূর্ণস্বায়ত্তশাসনকে
জেএসএস-এর পাঁচদফা মনে করতে হবে”। “জেএসএস পূর্ণস্বায়ত্তশাসন পেলে না করবে না”। “কেবল
পূর্ণস্বায়ত্তশাসন নয়, তারা স্বাধীনতাও চান"। এ ধরনের গোলমেলে কথা হাসপাতালে রোগী
শয্যায় শুয়ে বললে মানাবে, রাজনৈতিক আলোচনা-বিতর্ক বা সাক্ষাতকারে নয়। স্থান-কাল-পাত্র
বলে তো কথা আছে। জীবন বাবুরা ঠিক কোথা থেকে এই কথাগুলো বলছেন দয়া করে বলবেন কি? নিজে
বলে নিজেই নাকচ করে নিচ্ছেন। জীবন বাবুর পূর্ণস্বায়ত্তশাসন সম্পর্কে জ্ঞানগর্ব আলোচনা
আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের বুঝার সাধ্য নেই! স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে সাধারণ
মানুষের বিদ্যাবুদ্ধি দিয়ে তা বুঝা যাবে না ! সে সব বুঝার জন্য কোলকাতার বিলাসবহুল
প্রাইভেট ক্লিনিকে নয়তো পাবনার বহুল পরিচিত হাসপাতালটিতে ভর্তি হতে হবে, আর নয়তো আঞ্চলিক
পরিষদে ঢুকতে হবে তবেই তা বুঝা যাবে। যারা দু’টোর কোনটাতে নেই, তারা বোকার স্বর্গে
বাস করছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে জীবন বাবুদের
একটা বহুল প্রচারণা হচ্ছে ইউপিডিএফ পূর্ণস্বায়ত্তশাসন
সন্তু লারমার কাছ থেকে চায় কিনা? কেন সন্তু
লারমাকে সমালোচনা করে, সরকারকে না করে? বড় যুক্তি বটে!! প্রশ্ন তো এটাও করা যায়,
সন্তু লারমারা আঞ্চলিক পরিষদ কি আর্মির স্পাই-দালাল-সমীরণদের কাছ থেকে চেয়েছিলো? কেন
তারা তাদের ধরে ধরে খুন করছে? ইউপিডিএফ খুনের রাজনীতি বিশ্বাস করে না। গণতান্ত্রিকভাবে
আন্দোলন সংগ্রাম সংগঠিত করছে, গণসচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে। খুনের রাজনীতিতে অভ্যস্ত সন্তু
লারমারা যে কারণে স্পাইদের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত ছিলেন, সে একই কারণে আজ ইউপিডিএফ সন্তু
লারমার সমালোচনা করতে বাধ্য হচ্ছে। এবং তা করছে রাজনৈতিকভাবে। পশ্চিম পাকিস্তানীরা
গোলাম আজম চক্রকে বাংলার জনগণের বিরুদ্ধে যেভাবে ব্যবহার করেছে, একই কায়দায় আওয়ামী
লীগ সরকার পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন ঠেকানোর জন্য সন্তু লারমা চক্রকে পার্বত্য চট্টগ্রামের
জনগণের বিরুদ্ধে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। সে কারণেই জনগণের রোষ সন্তু লারমার উপর পড়ছে,
এটাই স্বাভাবিক। গত বছর ২২ এপ্রিল, ২২ অক্টোবর, ২৬ ডিসেম্বর আর এ বছর ২০ মে পিসিপি
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী বানচাল করে দিতে কি কান্ড করেছেন তা সবার জানা। এমনকি পিসিপি'র ঢাকা
শাখার নবীনবরণ অনুষ্ঠান ভন্ডুল করে দিতে তিনি নিজের ড্রাইভার আর বডিগার্ডকে সন্ত্রাসীদের
সাথে পাঠিয়েছিলেন।
শুধু জীবন বাবুর পূর্ণস্বায়ত্তশাসন
আলোচনা খুবই গোলমেলে। এ ক্ষেত্রে জেএসএস’এর সভাপতি সন্তু লারমার বক্তব্য দেখতে হয়।
তাতে আমরা আর সম্মানিত পাঠকরা কোন কূল-কিনারা পেতে পারি কিনা! সারেন্ডার করে খাগড়াছড়ি
স্টেডিয়ামে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সন্তু লারমা জানিয়ে দেন যে, ‘তারা (ইউপিডিএফ) পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণাঙ্গ
স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলছে। যে অধিকার চুক্তিতেই রয়েছে।” (আজকের কাগজ, ১১
ফেব্রুয়ারী ৯৮)।
যিনি সারেন্ডারের সময় পার্বত্য চুক্তিতে
‘পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন’ (ইউপিডিএফ’এর দাবি পূর্ণস্বায়ত্তশাসন) অধিকার আছে বলে নিশ্চয়তা
দিয়েছেন, এক বছর পেরোতে না পেরোতে তা তিনি বেমালুম সব ভুলে গেছেন! শব্দটিও শোনেননি,
বইয়ে পাননি বলে সাক্ষাতকার দেন, ‘তাদের (ইউপিডিএফ’এর)
পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসনের যে ব্যাখ্যা সেটা ঠিক নয়। পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন বলতে কোন
স্বায়ত্তশাসন পৃথিবীতে নেই। এমন কিছু পৃথিবীর কোথাও আছে বলে শুনিনি। কোন রাজনৈতিক বইয়েও
আমি দেখিনি।” (সাপ্তাহিক ২০০০, ২৬ নভেম্বর '৯৯, পৃষ্টা: ৩০)
এখানে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে,
যা তিনি “শোনেননি, বইয়ে দেখেননি, যা পৃথিবীতে নেই এমন কাল্পনিক বিষয়” কি করে পার্বত্য
চুক্তিতে থাকতে পারে? আর তিনিও বা কিভাবে “অবাস্তব কাল্পনিক বিষয়ে” তখন নিশ্চয়তা দিতে
পেরেছিলেন? সেই অদ্ভুত ভূতুরে কান্ড কি করে সংঘটিত হয়েছিলো? তখন যদি পিজিপি-পিসিপি-এইচডব্লিউএফ
আর জনগণ তার নিশ্চয়তায় নিশ্চিত থাকতেন, কি হতো? আজকে সরকারের প্রতারণা কি দেশে-বিদেশে
প্রচারিত হতে পারতো? যা নেই তা তিনি নিশ্চয়তা দিতে গেলেন কেন? ‘ব্লাফ’ দিতে চেয়েছিলেন
কি?
সন্তু লারমা বাবু যা ‘বইয়ে পাননি’
‘পৃথিবীর কোথাও আছে বলে শোনেননি’ সেই ‘অসম্ভব বস্তু’টি আমরা পাই কিনা আসুন সম্মানিত
পাঠক খুঁজে দেখি:
1. India Wins Freedom: Maulana Abul
Kalam Azad
The Muslim League demanded that the Muslim majority provinces should have full autonomy. [page-153]
২. বাংলাদেশ স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা:
মওদুদ আহমদ, পৃষ্ঠা-২৭সহ সব ক’টি পৃষ্ঠা।
৩. যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা (ডিসেম্বর,
১৯৫৩)
(১৯) লাহোর
প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব বংগকে পূর্ণ-স্বায়ত্তশাসন প্রদান ও সার্বভৌমিক করা
হইবে এবং দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা ব্যতীত আর সমস্ত বিষয় (অবশিষ্টাত্মক ক্ষমতাসমূহ)
পূর্ববংগ সরকারের হাতে আনয়ন করা হইবে এবং দেশরক্ষা বিভাগের স্থল বাহিনীর হেডকোয়ার্টার
পশ্চিম পাকিস্তানে ও নৌবাহিনীর হেডকোয়ার্টার পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করা হইবে এবং
পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র নির্মানের কারখানা নির্মাণ করতঃ পূর্ব পাকিস্তানকে আত্মরক্ষায়
স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হইবে। আনসার বাহিনীকে সশস্ত্র বাহিনীতে পরিণত করা হইবে।
৪. ন্যাপের ১৪ দফা (১৯৬৬ সালের ৪-৭ জুন কেন্দ্রিয়
কমিটির সভায় ‘জাতীয় মুক্তির কর্মসূচী’ শিরোনামে গৃহীত)
১। (ক)
ফেডারেল শাসন ব্যবস্থার অধীনে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারণের পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের
অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান।
৫. সংগ্রামী ছাত্র সমাজের ১১ দফা
(১৪ জানুয়ারী ১৬৬৯)
৩। নিম্নলিখিত
দাবীসমূহ মানিয়া লইবার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণস্বায়ত্তশাসন দিতে হইবে:
(ক) দেশের
শাসনতান্ত্রিক কাঠামো হইবে ফেডারেশন শাসনতান্ত্রিক রাষ্ট্রসংঘ এবং আইন পরিষদের ক্ষমতা
হইবে সার্বভৌম।
(খ) ফেডারেল
সরকারের ক্ষমতা দেশরক্ষা, বৈদেশিক নীতি ও মুদ্রা এই কয়টি বিষয়ে সীমাবদ্ধ থাকিবে। অপরাপর
সকল বিষয়ে অংগ রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা হইবে নিরংকুশ।
এখানে স্বল্প পরিসরে কেবল ঐতিহাসিক
মুহুর্তে উত্থাপিত দাবিগুলো তুলে ধরা হলো। আরো বিভিন্ন দলের দাবি ও ইশতেহার এখানে উল্লেখ
করার সুযোগ হলো না। সন্তু লারমাকে সবিনয়ে অনুরোধ করি, আপনি দয়া করে এখানে উল্লেখিত
দাবিগুলো পড়ুন। ঐ বই দু’টো খুলে দেখুন। পুরো বই পড়তে হবে না। একটু কষ্ট করে উল্লেখিত
পৃষ্ঠাগুলো উল্টিয়ে দেখুন। তারপর কথা বলুন, সাক্ষাতকার দিন। না জেনে মনগড়া কথা বলা
ঠিক নয়। জাতির এত বড় ভাগ্য নিয়ে লড়াই সংগ্রামে নামার আগেই আপনার এ সব জেনে নেয়া উচিত
ছিলো। তাহলে দীর্ঘ বাইশ বছরের সংগ্রামের আজকে এ পরিণতি হতো না। জনগণের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি
খেলতেন না। আঞ্চলিক পরিষদকে ধ্রুবতারা জ্ঞান করতেন না। বড় অবাক লাগে ‘পূর্ণস্বায়ত্তশাসন’
না জেনে আপনি আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার সংগ্রামে নেমেছিলেন। পিসিপি হতে কর্মি বাগিয়ে নেয়ার
জন্য এক দফার সংগ্রামে নামবেন বলেও জানিয়ে দিয়েছিলেন। এক দফার সংগ্রাম বলতে আপনি কি
বুঝেন তা পরিষ্কার হয়েছে চুক্তি আর সারেন্ডার করার মধ্য দিয়ে। আপনার এক দফা হচ্ছে সারেন্ডার
করা। অন্যরা সেটা বুঝেছে বিচ্ছিন্নতা। সেলুকাস! বড় বিচিত্র আজ দেশ।
জানতে ইচ্ছে হয় এখানে উল্লেখিত বই
দু’টোকে রাজনৈতিক বই মনে করেন কিনা? নাকি পৃথিবীর বাইরে মঙ্গল গ্রহ থেকে আনা হয়েছে
বলে সন্দেহ করেন আবার! আপনাকে জব্দ করতে ফ্লাইং সসারগুলো এনেছে বলে ধরে নেন! দয়া করে
আপনার পড়া রাজনৈতিক বইগুলোর রেফারেন্স দেবেন কি, যে বইগুলোতে আপনি পূর্ণস্বায়ত্তশাসন
দেখেননি? আপনার রাজনৈতিক বইগুলোর বহর দেখতে খুব ইচ্ছে হয়। যে বইগুলো থেকে রাজনৈতিক
ও ঐতিহাসিক জ্ঞান আহরণ করে আজ আপনি আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের পদ অলঙ্কৃত করে রয়েছেন!
দেশ-জাতির সেবায় শান্তির অবতার বনে গেছেন!!
আপনার নিজের যা কিছু জানা নেই, তা
দুনিয়ার কোথাও আর তা থাকবে না, থাকতে পারেনা, যদি তার জানার বাইরে কিছু থেকেও থাকে,
তাহলে সে সব সঠিক নয়, সেগুলোর দরকার, জানতেও নেই! এ সবই এতকাল আপনি বলে এসেছেন। সাধারণ
কর্মিদের বুঝিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত চুক্তি ও সারেন্ডার করে আঞ্চলিক পরিষদে আশ্রয় নিয়েছেন।
যারা আপনার জানার বাইরে কোন তথ্য জানে, খবর রাখে, তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে শাস্তি
চায় না। তারা বিদেশের খপ্পরে পড়েছে। তারা শান্তি বিনষ্টকারী। তাদের পলা টিপে হত্যা
করতে হবে, হাত-পা ভেঙে দিতে হবে! এই হচ্ছে আপনাদের মানসিকতা।
এখানে এত সব আলোচনার পর হাটে হাঁড়ি
ভেঙে যাওয়ায় সন্তু লারমা ভড়কে গিয়ে যে বোলচাল পাল্টাবেন তাতে সন্দেহ নেই। ‘পূর্ণস্বায়ত্তশাসন’
বইয়ে নেই কথাটি আর তারা বলতে পারবেন না। সেটা বলতে না পারলেও তাদের মুখ বন্ধ করা যাবে
না। তাতে আমাদের করার কিছু নেই। কথায় বলে, ‘এক ন জিনে নুদি সমারে, আর এক ন জিনে উধী
সমারে।’ পূর্ণস্বায়ত্তশাসন পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য নয়, তাতে বিচ্ছিন্নতাবাদের
গন্ধ আছে, তা হঠকারীতা, উগ্রতা, তা পাওয়া যাবে না, সম্ভব নয়, জনগণ তার জন্য উপযুক্ত
নয়, তা ব্যক্তি রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ... ইত্যাদি প্রচারণা চালাবেন। আগে সরকার পার্বত্য
চট্টগ্রাম সমস্যাকে “অর্থনৈতিক সমস্যা” বলে চিহ্নিত করতো। ‘রাজনৈতিক সমস্যা’ কথাটি
মুখেই আনা যেতো না। আন্দোলনের ফলে সেই অবস্থা আর নেই। কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। বর্তমান
সময়ে আবার পূর্ণস্বায়ত্তশাসন দাবি নিয়ে যাতে কেউ আন্দোলন করতে না পারে সে ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক
প্রচারণা চলছে। জেলা পরিষদ ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলে তখনও সরকার আর দালালদের পক্ষ থেকে
বলা হতো তার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এখন জেএসএস ‘পার্বত্য
চুক্তি’ বাস্তবায়িত হলে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে বলে জোর প্রচারণা চালাচ্ছে।
আন্দোলনের আর প্রয়োজন নেই ইত্যাদি বলে জনগণের সংগ্রামী চেতনা ভোঁতা করে দিয়ে যুগ যুগ
ধরে দমিয়ে রাখার সরকারি নীল নক্সা বাস্তবায়ন করে দিচ্ছে। ভবিষ্যতে যাতে আর আন্দোলন
সংগ্রাম গড়ে না উঠে, সে উদ্দেশ্যে সরকার জেএসএসকে দিয়ে এসব প্রচারণা চালাবে। তাদের
কথাবার্তার ধরন দেখে তা বুঝতে কারোর অসুবিধা হয় না।
৪. পিসিপি গঠন প্রসঙ্গে : জীবন বাবুর ভাষায়, “... আশি দশকের গোড়া থেকেই প্রসিত বাবুদের জেএসএস নৈতিক ও আর্থিকভাবে সহযোগিতা দিয়েছে একথা কারোর অজানা নয়। বাইরে ছাত্র আন্দোলন দাঁড় করানোর প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে জেএসএস একান্তভাবে নিবেদিত ছিল। এই নিরলস প্রচেষ্টায় গড়ে উঠে আজকের পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের আন্দোলন।” [সম্মানিত পাঠক দেখুন: ‘প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে জেএসএস নিবেদিত ছিল’ কথাটিই ভুল]
জীবন বাবুদের এই হচ্ছে ব্যায়ারাম। বাইরের ছাত্র আন্দোলন থেকে তারা কৃতিত্ব নিতে চান! তথ্যের বিকৃতি আর মিথ্যাচারই হচ্ছে তাদের প্রধান অস্ত্র। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের আন্দোলনের কৃতিত্ব থেকে ভাগ বসাতে না পারলে, সন্তু লারমার নেতৃত্বের জাত থাকে কোথায়!! কাজেই ‘আমি হেন করেনু তেন করেনু’ নানান ফিরিস্তি দিয়ে ছাত্র আন্দোলনের কৃতিত্ব ও গৌরব থেকে ভাগ তো বসাতে হবে। আর ‘স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনের সুনামে’ কেউ ভাগ বসাচ্ছে বলে মনে হলে, তাদের হিট লিষ্টে তুলতে হবে-- এই তো সন্তু লারমার মানসিকতা? সে কারণে ‘হুয়াঙ বোইও বা’ পাঠাগারটি সন্তু লারমা গুন্ডা লেলিয়ে দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন।
কথাটা এখানে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে এবং বিশেষভাবে সন্তু লারমার উদ্দেশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলা দরকার যে, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের আন্দোলন গড়ে উঠার পেছনে সম্ভ লারমার কোন ভূমিকা নেই। বরং তিনি এ ধরনের আন্দোলনকে সব সময়ই নিজের নেতৃত্বের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করতে পারে বলে নানাভাবে দাবিয়ে রাখতে চাইতেন, এ সত্য কথাটি আজ এখানে প্রসঙ্গ উঠেছে বলে বলতে হলো। নতুন নেতৃত্ব গড়ে উঠলে সন্তু লারমাদের গোষ্ঠি নেতৃত্ব টিকিয়ে রাখা দায় হতে পারে এই আশঙ্কায় সন্তু লারমারা সব সময় শংকিত থাকতেন, এটা জনসংহতি সমিতির প্রাক্তন এবং বর্তমান সব সদস্যরাই এক বাক্যে বলবেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে সমস্ত ধরনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সৃজনশীল সংগঠন নিষিদ্ধ করে দেবার পেছনেও এটিই ছিলো মূল কারণ। জনসংহতি সমিতিতে নেতৃত্ব গতিশীল ও বিকাশ না হবার হেতুও হচ্ছে এটিই।
এটা এখানে আরো বলা দরকার যে, সন্তু লারমাদের সংকীর্ণ মানসিকতার কারণেই পার্বত্য চট্টগ্রামে ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠতে যথেষ্ট সময় লেগেছে। সন্তু লারমারা এতই যদি ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য নিবেদিত থাকেন, তাহলে তারা কেন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের আগে ছাত্র আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেননি? পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের আবির্ভাবের বহু আগে থেকেই তো প্রবাসী পাহাড়ি ছাত্র সমিতি ছিলো। সেই প্রবাসী পাহাড়ি ছাত্র সমিতি’কে দিয়ে কেন তারা ছাত্র আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি? দয়া করে সন্তু লারমা বাবু কি কথাটির উত্তর দেবেন? এ কথাটির দ্বারা প্রবাসী পাহাড়ি ছাত্র সমিতির কাউকে দোষ দেয়া হচ্ছে না। জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বের অক্ষম অনুভূতি বোঝানোর জন্যই আজ এ প্রশ্নগুলো তুলতে হচ্ছে। সন্তু লারমা ইনিয়ে বিনিয়ে ভাবভঙ্গী দেখিয়ে এমন অর্থ বোঝাতে চান যেন, তার উপদেশ-পরামর্শ-অর্থ নিয়েই পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ গঠিত হয়েছে, নির্লজ্জ বেলেল্লাপনা আর কাকে বলে!
যদি পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ গঠনে সন্তু লারমা সামান্য পরামর্শ-উপদেশ থাকতে, তাহলে আজকের পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ গঠিত হতো না, ছাত্র আন্দোলনও গড়ে উঠতো না। সন্তু লারমাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘প্রবাসী পাহাড়ি ছাত্র সমিতি’র মতো সংগঠনই হতে পারে, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ নয়। পুনরাবৃত্তি হলেও এ কথাটি সবার জন্য থাকার জন্য আবারো দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা দরকার যে, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ বাইর থেকেই গড়ে উঠেছে। এ ব্যাপারে কথা বাড়ানো উচিত মনে করি না। কথা বাড়াতে চাইলে আরো অনেক কথা এসে যাবে, সেটা জীবন বাবু এবং সন্তু লারমার জন্য আরো বেশী সুখকর হবে না।
“আশির দশকের গোড়া থেকেই প্রসিত বাবুদের জেএসএস নৈতিক ও আর্থিকভাবে সহযোগিতা দিয়েছে..” কথাটির দ্বারা কি বুঝাতে চান জীবন বাবু? এখানে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, আশি দশকের গোড়া বলতে কি বুঝেন জীবন বাবুরা??? প্রশ্নটি রূঢ় হলেও এ কারণে করতে হচ্ছে যে, অর্থ ঠিকমতো না বুঝে বাগাড়ম্বরের জন্য চটকদার শব্দ ব্যবহার করা এটাও জীবন বাবুদের একটা অভ্যাস। সাধারণ কর্মিরা অসংলগ্ন বাগাড়ম্বরপূর্ণ শব্দ বোমা শুনে ভিমরি খেয়ে পড়লেও যারা প্রকৃত অর্থ জানে তাদের কাছে জীবন বাবুরা এ কারণেই বারবার হাস্যম্পাত্র হন, তার দৃষ্টান্ত অনেক, লেখা দীর্ঘ হয়ে যাবার ভয়ে দৃষ্টান্ত দেবার লোভ সংবরণ করলাম। আশি দশকের গোড়া বলতে ’৮০ সন থেকে ’৮১-৮২ সন এটাই বুঝায়। তখন প্রসিত খীসারা স্কুলের ছাত্র। জীবন বাবু বেশধারী জনসংহতি সমিতির নেতাও সে সময় স্কুলের ছাত্র। জনসংহতি সমিতি তখন ঘোরতর ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধে লিপ্ত, যা লাম্বা-বাদি যুদ্ধ নামে পরিচিত। ঐ সময়ে জনসংহতি সমিতির কোন নেতা বা কেষ্টবিষ্টুর সাথে প্রসিত খীসা বা তার কোন সঙ্গীর দেখা-সাক্ষাত হবার প্রশ্নই আসে না। নৈতিক-আর্থিক সাহায্য হাস্যকর ভন্ডামী ছাড়া আর কি হতে পারে।
’৮৪ সানের গোড়া দিকে, জীবন বাবুদের বুঝার সুবিধার্থে আরো খোলসা করে বলা দরকার জানুয়ারির প্রথমার্ধে, কলেজ ছাত্র ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার্থী প্রসিত খীসা কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে খাগড়াছড়ি পেরাছড়ার গহীন অরণ্যে বর্তমান জনসংহতি সমিতির নেতা পেলে’দের (তখন তালুক বাবু) সাথে দেখা করে তাদের গ্রুপের প্রতি অর্থাৎ লাম্বাদের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন। প্রসিত খীসাদের ঐ দলে তখন জীবন বাবু ছিলেন না। পেলে গ্রুপে সে সময় যারা ছিলেন তাদের অনেকের সেই দিনটির কথা মনে থাকবে। তাদের সাথে প্রসিত খীসাদের কি আলাপ হয়েছিলো তাও অনেকের মনে থাকার কথা। তারপর থেকে খাগড়াছড়ির যুব সমাজ লাম্বা গ্রুপকেই সমর্থন দিয়েছিলো। বাদি গ্রুপের কিছু সমর্থক থাকলেও সবাই লাম্বা গ্রুপকেই সমর্থন জানাতে বাধ্য হয়। গণদুশমন সমীরণ জল ঘোলা করার মতলবে তখন খাগড়াছড়িতে অবস্থান নিয়েছিলো। সন্তু লারমাদের বিরুদ্ধে সে অনেক কথাবার্তাই শুরু করে দিয়েছিলো। তার কথাবার্তায় জীবন বাবুও বলতে গেলে প্রভাবিত হয়েছিলেন, তা তিনি অস্বীকার করতে পারবেন না। সন্তু লারমার প্রতি জীবন বাবুসহ দু’একজনের মনোভাব ভাল ছিলো না। পরিহাসের বিষয়, তারাই সন্তু লারমার এখন সবচেয় আপন ঘনিষ্টজন। জীবন বাবু এখন যেমন সন্তু লারমার পক্ষে কথা বলছেন, সে সময় তিনি সন্তু লারমার প্রতি ছিলেন ততটাই অনীহ।
জীবন বাবু তার খোলা চিঠিতে লিখেছেন, প্রসিত খীসা “...স্কুল জীবনে গড়ে তুলেছিল আদর্শ যুব সংঘ। পরবর্তী পর্যায়ে গড়ে তুলে পার্বত্য যুব ও ছাত্র সংহতি সংঘ নামের গোপন অখড়া। জেএসএস’এর আর্থিক সহায়তায় এ আখড়ার জন্ম হলেও জেএসএস কোন দিন জানতে পারেনি এর গোপন কর্মসূচী।” প্রসিত খীসা তার স্কুল—কলেজ জীবনের সঙ্গী—সাথীদের আন্দোলন সংগ্রামের কথা বলার সময় এখনো হয়নি বলে মনে করেন। সে ঘটনাবলী তিনিই ভালো তুলে ধরতে পারবেন। তবে এখানে আমি জীবন বাবুকে প্রশ্ন রেখে বলতে চাই, আপনি কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারেন, সে সময় গোপন সংপঠন করার জন্য প্রসিত খীসা সন্তু লারমার সাথে পামর্শ করেছিলেন? ’৭৫ সন থেকে ’৮০ সনের ২২ জানুয়ারির আগ পর্যন্ত সন্তু লারমা ছিলেন জেলে। পরে শান্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েই তো তিনি এক অঘটন ঘটান। যার পরিণামে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে জীবন দিতে হয়। পরবর্তীতে ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধ করতেই সন্তু লারমা দিন শেষ করেছেন। তিনি কোথায় কি আন্দোলন করলেন সেটাই তো বিশ্লেষকদের বড় জিজ্ঞাসা হয়ে আছে। অন্যের গড়া পার্টি আর কর্মি নিয়েই তো তিনি দরকষাকষি করে স্বার্থ হাসিল করলেন। যাকে বলে গণধিকৃত স্বৈরাচারী এরশাদের মতো আর কি। অন্যজনের কবিতা, অন্যের গান, ভিন্ন দলের পার্টির কমি, পরের স্ত্রী (কথাটি বলতে মুখে বাধলেও সত্যের খাতিরে বলতে হলো), পরের ছেলে নিয়ে... ... পোদ্দারী দেখানো!!!
প্রসিত খীসারা স্কুলে থাকতেই সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন সে কথা তো জীবন বাবুই নিজে স্বীকার করছেন। সন্তু লারমা নৈতিক জোর থাকলে প্রসিত খীসাদের সেই সংগঠন সম্পর্কে জোর সাহস কেন দেখাতে পারেননি? আমার প্রশ্নটি এ জায়গায়ই। জানতে চাওয়ার মতো নৈতিক জোর সন্তু লারমা বাবুর ছিলো না বলেই তো তিনি তা করতে পারেননি। জনসংহতি সমিতির সাধারণ সদস্যদের পান থেকে চুন খসার অতি সাধারণ ব্যক্তিগত বিষয়গুলোর ব্যাপারে যিনি নাক গলাতে দ্বিধা করেন না, তিনি কোন অযোগ্যতা বা অক্ষমতার কারণে প্রসিত খীসাদের সংগঠন সম্পর্কে জানার সাহস দেখাতে পারেননি? তার অক্ষমতার কথা সন্তু লারমা বাবু ব্যাখ্যা দেবেন কি?
প্রসিত খীসার কাছে জীবনের দর্শন কখনই “এই পৃথিবী টাকার গোলাম” ছিলো না, জীবন বাবুদের কাছে সেটাই ছিলো একমাত্র দর্শন। স্কুল জীবনে দেখা যাত্রার সেই নাটকটি জীবন বাবুর জীবনে গভীর ছায়াপাত করে। কথায় কথায় তিনি তাই উদ্ধৃত করতেন। সে কারণে স্কুল ছাত্র থাকাকালে জীবন বাবুরা চাইতেন দোকান দিয়ে মুনাফা করতে। আর প্রসিত খীসা চাইতেন তখন থেকেই উন্নত চিন্তাধারা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করতে আর নীতি-আদর্শের ভিত্তিতে ছাত্র সংগঠন গড়ে তুলতে, সে সময় সংগঠন আর রাজনীতি ছিলো নিষিদ্ধ। জীবন বাবু তখন থেকেই দু’একজনকে জুটিয়ে আড়ালে আবডালে প্রসিত খীসার বিরুদ্ধে টিপ্পনী কাটতেন। সে সময়েও আড়ালে বলতেন প্রসিত খীসা নিজেও মরবে, আর তাদেরও (জীবন বাবুদের) বিপদে ফেলবে, বর্তমানে খোলা চিঠিতেও একই সুরে কথা বলছেন, এখনতো তিনি সন্তু লারমার ডান হাত। যদিও সে সময় জীবন বাবু সামনে কখনই সে সব কথা বলার সাহস পেতেন না। জীবর বাবুর মনে রাখা উচিত ছিলো, আকাশের দিকে থু থু নিক্ষেপ করলে তা নিজের মুখের উপর পড়ে। গণদুশমন সমীরণ ছাত্র—যুব সমাজের সাথে বেঈমানী করে তখনকার সময়ে স্বৈরাচারী এরশাদের পার্টি “জনদলে” যোগ দেয় আর খাগড়াছড়ি তরুণ-যুব সমাজকেও তার মতো বিপথে পরিচালিত করতে অনেক অপচেষ্টা চলিয়েছিলো। জীবন বাবুও সে সময় গণদুশমন সমীরণের সুবিধাবাদী তত্ত্বে মোহিত ও প্রভাবিত হয়েছিলেন। এমন কি তার সপক্ষে প্রাথমিক কথাবার্তাও শুরু করে দিয়েছিলেন। প্রসিত খীসার জোরালো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আর অন্যান্য সঙ্গী-সাথীদের হাতে জোরালো সমর্থন দেবার কারণে সে যাত্রায় জীবন বাবুর পক্ষে তাদের মাঝ থেকে বেরিয়ে গিয়ে সমীরণের সাথে যোগ দেয়া আর সম্ভব হয়নি। যখনই কোন সংকটময় পরিস্থিতির উদ্ভব হতো, তখন জীবন বাবুর অতি পরিচিত অজুহাত ছিলো “বাই চান্স” চিটাগং চলে যাওয়া। আর নিরাপদ মুহুর্তে সব সময়ই তিনি পালিয়ে থেকেছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েও আমি বারে বারে তা লক্ষ্য করেছি। সে কথায় পরে আসবো।
যে কথা শুরু করেছিলাম, নিবেদিতপ্রাণ কিছু ঘনিষ্ট সঙ্গী—সাথী নিয়ে প্রসিত খীসা সংগঠন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। যারা আন্দোলন সংগ্রামের একটা পর্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো। পরবর্তীতে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ গঠিত হলে তাদের মধ্যে অনেকে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়। সে ঘটনাবলী বিবৃত করা আমার লেখার উদ্দেশ্য বা বিষয় নয়। ঘটনা প্রসঙ্গে এসে গেছে এটুকু পর্যন্ত। সে সব মূল্যায়ন হবে ভবিষ্যতে কোন সময়।
“এই পৃথিবী টাকার গোলাম” জীবনের দর্শন এই হবার কারণে ছাত্র থাকাকালে আন্দোলনে আমাদের সঙ্গ দিলেও শেষ পর্যন্ত জীবন বাবু আসলেই “টাকার গোলাম” বনে গেছেন। নিজের অভিরুচিই চারিতার্থ করেছেন।
তার চিঠির ভাষায় “গুটি কয়েক ছাত্র যুবককে নিয়ে নানা নামে সংগঠন (দোকান) খুলে বসা যায় কিন্তু আপামর জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনে তেমন কোন ভূমিকা রাখতে পারা চাট্টিখানি কথা নয়।” [সম্মানিত পাঠক লক্ষ্য করুন: তেমন কোন ভূমিকা রাখতে পারা চাট্টিখানি কথা নয়-এটি ব্যাকরণগতভাবে ভুল]
জীবন বাবুর চিন্তা-চেতনা এখনো স্কুল জীবনের লেভেল থেকে উপরে উঠতে পারেননি। তার কথাতে সেটাই প্রকাশ পাচ্ছে। সংগঠন বলতেই তিনি এখনো পর্যন্ত “দোকান”ই বুঝেন। আর অন্য কিছু হোক না হোক, জনসংহতি সমিতিতে যোগ দিয়ে সমিতিকে একটা বড় দোকানে পরিণত করতে তিনি স্কুল জীবনে দোকান দেবার অভিজ্ঞতা বেশ কাজে লাগাতে পেরেছেন বুঝা গেল। তিনি বেশ সফল আর দক্ষতার সাথেই দোকানের অভিজ্ঞতা প্রয়োগ করতে পেরেছেন বলতে হবে। তার এই কৃতিত্বের জন্য তাকে সাধুবাদ দিতে হয়। সন্তু লারমাকে সত্যিই জনসংহতি সমিতি নামের বড় দোকানের মালিক বানিয়ে ফেলেছেন আর নিজের মালিকের একান্ত আপনজন বনে গেছেন। সে জন্য তো লোকে বলে, জনসংহতি সমিতি এখন “শ্বাশুর এন্ড জামাই প্রাইভেট কোং লিঃ”।
যারা জীবনের মতো “এই পৃথিবী টাকার গোলাম” তাকে তো “টাকা” কেবল “টাকাই” টানবে এটাই স্বাভাবিক। সে কারণে জীবন বাবু আন্দোলন পেছনে ছুঁড়ে মেরে হুরমুড় করে চাকুরীতে যোগ দিতে গিয়েছিলেন। সারারাত কথা বলে, এতজনের কাছে ওয়াদা দিয়েও তারপরের দিন ভোরে কাউকে কোন কথা না বলে চাকুরীর উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন। এখন তিনি টাকার পাহাড়ে গড়াগড়ি দিয়ে নিরাপদ দূরত্বে (কোলকাতায় অভিজাত এলাকায় অবস্থান করে, বাড়ী নাম্বার দিলাম না) থেকে ভাবছেন “মহাবিপ্লবী” বনে গেছেন!! জীবন বাবু আপনি সত্যিই “টাকার গোলাম” বনে গেছেন। টাকা না হলে সন্তু লারমা কেন কেউই আপনাকে বেঁধে রাখতে পারতো না। আপনি ছুটে পালাতেন টাকার সন্ধানে। আন্দোলন সংগ্রাম তাতে ডুবলো, কি এগুলো, তার পরোয়া করতেন না। সঙ্গী-সাথীরা আপনার ভূমিকা নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়লো কিনা তাও আপনি ভ্রম্নক্ষেপ করতেন না। ধূর্ত সন্তু লারমা শুধু টাকা নয়, আর কোন কারণে আপনাকে বেঁধে রেখে গোলাম বানিয়েছে তা কি লোকে বুঝে না??? যে সন্তু লারমার সমালোচনায় আপনারা ছিলেন সোচ্চার, এখন তারই গুণকীর্তনে আপনি পঞ্চমুখ। বলতে গেলে তার দক্ষিণহস্ত। পরিহাসের বিষয়, সে সময় সন্তু লারমাকে প্রসিত খীসারাই তরুণ যুবকদের কাছে তুলে ধরে রক্ষা করেছিলেন।
কাচের ঘরে আবদ্ধ থেকে অন্যের দিকে ঢিল ছুঁড়ার দুঃসাহস কিভাবে আপনার হলো সেটা ভাবতে আশ্চর্য লাগে। অন্যদের ব্যাপারে কথা বলার আগে নিজের চেহারা দেখা উচিত জীবন বাবু।
সন্তু লারমার একান্ত ঘনিষ্টজন হওয়ায় আপনাকে মানিয়েছেও বেশ। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণকে না কুলিয়ে ইন্টারনেটে দেশের বাইরে জুম্মোদেরকেও “ফরেন এফেয়ার্স মিশন প্রধান” পদবী লাগিয়ে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে চলেছেন, তা তো দেশের বাইরের সব জুম্মোরাই দেখেছে। “ফরেন এফেয়ার্স মিশন” বলে কোন কিছু নেই। হয় “ফরেন এফেয়ার্স সেকশান” বলতে হবে, নয়তো “ফরেন মিশন” বলতে হবে। জীবন বাবুর এতই মাথা ভারী হয়ে গেছে যে, নিজেকে নিজে চিনতে পারছেন না! হায় দুনিয়া!!! তুমি যখন টাকার গোলাম হও তখন কি হয়ে পড়ো!!!
ডিগবাজী খাওয়ার মধ্যেও তো বেশ পারদর্শীতা দেখাচ্ছেন জীবন বাবু। এক সময় খাগড়াছড়ির বৈসাবি সংকলনে যে জীবন বাবু গণদুশমন সমীরণের বিরুদ্ধে খোলা চিঠি দিয়ে ছাত্রদের সমর্থন কুড়াতে পিছ পা হন না, আজ তিনি গণদুশমন সমীরণসহ আরো কত থার্ড ক্লাশ নিকৃষ্ট দালালের সাথে মাখামাখি করছেন তাদের দেখলে ঘেন্না লাগে। যে ধিকৃত নারী পাচারকারীকে শাস্তি দিতে জীবন বাবুরা খাগড়াছড়ি কলেজ মাঠে (’৯১ সালে) গণপিটুনীর আয়োজন করেছিলেন, সেই নারী পাচারকারীকে সম্মানিত অতিথি করে জীবন বাবু আর সন্তু লারমারা বিশেষ ব্যবস্থায় ধুধুকছড়ায় নেবার ব্যবস্থা করেছিলেন। ধুধুকছড়া সে সময় কুখ্যাত “কাশিম বাজারের কুঠি”তে পরিণত হয়। সমস্ত ধরনের টাউট—বাটপাররা ধুধুকছড়ায় ভিড় জমিয়েছিলো। নারী পাচারকারী থেকে শুরু করে লম্পট, ভিলেজ পলিটেশিয়ান, সমাজ অনিষ্টকারীদের বিশেষ মর্যাদায় সন্তু লারমা ধুধুকছড়ায় ডেকে নিয়ে গোপন আলোচনায় মেতে উঠেন। তাদের নিয়ে ষড়যন্ত্রের গোপন নীল নক্সা প্রণয়ন করেন। বাইরের উত্তাল আন্দোলনে ল্যাঙ মারাই ছিলো তার আসল উদ্দেশ্য। পরবর্তীতে সেনাবাহিনী আর সন্তু লারমার যোগসাজশে ঐ ধিকৃত নারী পাচারকারী আর সমাজের চোর বখাটে ছেলেদের নিয়ে গঠিত হয়েছিলো কুখ্যাত “মুখোশ বাহিনী”। সে মুখোশ বাহিনীর তান্ডবের কথা এখনো খাগড়াছড়িবাসী ভুলে যায়নি। নরাধম নারী পাচারকারীকে ঠিকাদারী কাজ পাইয়ে দিতে জীবন বাবু-সন্তু লারমারা কত নিকৃষ্ট কাজে হাত দিয়েছিলেন, তার সাক্ষী পানছড়ির প্রতিবাদী ছাত্র সমাজ। রাতের অন্ধকারে মাইক্রোবাস নিয়ে খাগড়াছড়ি সেনা ব্রিগেড থেকে পানছড়িতে শান্তিবাহিনীর কমান্ডার রেনন (গরমপানি)-এর কাছে যাওয়া, পথে কোন কিছু হলে পিসিপি-পিজিপিকে দায়ী করা, হুঁশিয়ারী দেয়া এবং নারী পাচারকারীকে কন্ট্রাক্টরী কাজ পাইয়ে দেয়া-চুক্তি ও সারেন্ডারের আগে থেকেই এসব কিসের আলামত চলছিল তা ওয়াকিবহাল মহল অনেক আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। মুখোশ বাহিনী গঠন করে পিসিপি-পিজিপি-এইচডব্লিউএফ’কে দুর্বল করতে খাগড়াছড়ির সেনা ব্রিগেড আর ধুধুকছড়ার মধ্যে কি গোপন দুতিয়ালী চলে তার কি জবাব দেবেন সন্তু লারমা—জীবন বাবু?? ’৯৫ সালে সন্তু লারমা গুলতি মেরে, জঙ্গী আন্দোলন করে আন্দোলন করা যাবে না বলে সেনা গোয়েন্দাদের উদ্দেশ্যে কিসের সিগন্যাল দিয়েছিলেন? যার পরে পরেই সেনা ব্রিগেড থেকে মুখোশ বাহিনী পিসিপি-পিজিপি’এর বিরুদ্ধে খাগড়াছড়িতে মিছিল বের করেছিলো? ঢাকায়ও মিছিল করতে গিয়েছিলো। জীবন বাবু আবার খেদ মিশিয়ে বলছেন “সেনাবাহিনীর সাথে যাদের যোগসাজশ ছিল তারাও দালাল।” তার মানে হচ্ছে জীবন বাবুদের বিবেচনায় সেনাবাহিনীর সাথে যোগসাজশকারীরা দালাল-স্পাই নয়! মুখোশ বাহিনী সেনাবাহিনীর গুটি হলেও তারা দালাল নয়! সেজন্যই জেএসএস’এর কাছে মুখোশদের কদর বেড়ে যায়, সেনাবাহিনীর কাছেও তারা ছিল আদরের। সমাজ অনিষ্টকারী ভিলেজ পলিটিশিয়ান হয়ে যায় সন্তু লারমার রাজনৈতিক উপদেষ্টা।
সন্তু লারমা-জীবন বাবুদের বিবেচনায় মুখোশ-দালাল-স্পাইরা তাদের স্বার্থ ও ক্ষমতার গদির জন্য হুমকী নয়। হুমকি হচ্ছে উঠতি যুব নেতা প্রদীপ লাল আর কুসুম প্রিয়ের মতো নেতারা। সে কারণে উদীয়মান যুব নেতা কুসুম প্রিয়ের নির্বাচনী বিজয় ঠেকানোর হীন উদ্দেশ্যে দুর্বৃত্ত রেনন (গরমপানি) পানছড়ির ভোটকেন্দে্র জালিয়াতি করতে গিয়ে জনতার হাতে গণপিটুনী খেয়ে অস্ত্রসহ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। তাকে ছাড়িয়ে নেয়ার কাহিনীও জনগণের জানা। ‘পাপ বাপকেও ছাড়ে না’। তখনকার সেনা ব্রিগেডের গোয়েন্দা কর্মকর্তা কুখ্যাত জি-টু মেজর মেহবুব যে মুখোশ বাহিনীর দায়িত্বে ছিলো, পরে সে নানান অপকর্মের জন্যই চাকুরীচ্যুত হয়। নিয়তির কি বিচার! শান্তিবাহিনীর কমান্ডার রেনন (গরমপানি) পানছড়িতে গণপিটুনী খাওয়ার পরদিনই ঢাকার বাড্ডায় মাইক্রোবাস ছিনতাই করতে গিয়ে নরপশু মেহবুব গণপিটুনীর শিকার হয়, আর শ্রীঘরে যেতে বাধ্য হয়।
জীবন বাবুদের কাছে পৃথিবীতে নীতি-আদর্শ সত্য নয়। তাদের কাছে সত্য বহু। আসল কথা হচ্ছে যখন যেমন তখন তেমন ভাবভঙ্গী দেখিয়ে স্বার্থ হাসিল করাই হচ্ছে তাদের কাছে সত্য। তার প্রতিফলন তারা অহরহ দেখিয়ে চলেছেন। যাদের দালাল বলে চিহ্নিত করেছেন, তাদের সাথে এখন জীবন বাবুদের লজ্জাকর মিতালী দেখে পার্বত্যবাসীদের বমির উদগীরণ হয়। মাটিতে ফেলা থু থু দিয়ে এখন জীবনবাবু-সন্তু লারমার কপালে তিলক পরেছেন। এসবই হচ্ছে তাদের কাছে “সত্য” “আদর্শ” “কৌশল” আর “কূটনীতি”। বিশ-বাইশ বছর ধরে তারা এ ধরনের “কৌশল” আর “কূটনীতির” খেলা খেলে দেশ-জাতির বারটা বাজিয়েছে, আর এখনো ক্ষান্ত হননি। (সূত্র: স্বাধিকার বুলেটিন নং ১৭)
(চলবে...)
* ১ম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন এখানে
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।