সচিব চাকমা
কেন্দ্রীয় সদস্য, ইউপিডিএফ
গতকাল ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ ঢাকায় “সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র জনতার” সমাবেশে হামলা হয়েছে। “স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি” নামের হঠাৎ গজে ওঠা একটি সংগঠনের লোকজন পুলিশের উপস্থিতিতে এই হামলা চালায়।
পত্রিকান্তরে জানা যায়, ”সংক্ষুব্ধদের”
মতিঝিলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ভবন ঘেরাও কর্মসূচি
কয়েকদিন আগে ঘোষণা করা হয়েছিল। অপরদিকে “সভারেন্টিরা” হঠাৎ একই দিন একই সময়ে ও
একই স্থানে পাল্টা কর্মসূচি ঘোষণা দেয়। এরপর তারা গতকাল জাতীয় পতাকা বাঁধা
স্টাম্প ও লাঠি নিয়ে আগেভাগে এনসিটিবি ভবনের সামনে জড়ো হয়। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা
যায় তাদের হামলা ছিল পূর্ব পরিকল্পিত।
মিডিয়ার সামনে এই প্রকাশ্য হামলায় বেশ
কয়েকজন আহত হন, যাদের মধ্যে নয় জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়েছে।
এনসিটিবি সামনে হামলা চালাচ্ছে স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টির সন্ত্রাসীরা। সংগৃহিত ছবি |
সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র জনতার এই শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক কর্মসূচিতে হামলা একটি সত্যকে সামনে হাজির করেছে। তা হলো আগস্ট অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন হলেও দেশে ফ্যাসিজম নির্মূল হয়নি। বরং ফ্যাসিস্টরা নতুন রূপে নতুন চেহারা নিয়ে আবির্ভুত হয়েছে। এদের সামান্যতম পরমত সহিষ্ণুতা ও অন্যের গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নেই।
এই উগ্র সাম্প্রদায়িক স্টুডেন্টস ফর
সভারেন্টি সংগঠনটির ফ্যাসিস্ট চেহারা দেখুন। নবম ও দশম শ্রেণীর “বাংলা ভাষার
ব্যাকরণ ও নির্মিতি” বইয়ের পেছনের প্রচ্ছদে ‘আদিবাসী’ শব্দ থাকা আগস্ট অভ্যুত্থান
সময়ের একটি গ্রাফিতি যুক্ত করা হলে স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি তা বাতিলের দাবি
জানায়। তারা এনসিটিবির অফিসে মারমুখী হয়ে ঢুকে উক্ত গ্রাফিতি সরিয়ে নতুন একটি
গ্রাফিতি দিতে বাধ্য করে। সরকার এই ক্ষুদ্র ফ্যাসিস্ট গোষ্ঠিটির চাপের মুখে নতজানু
হয়ে পাঠ্য বইয়ের পিডিএফ সংস্করণ থেকে কেন ‘আদিবাসী’ শব্দ থাকা গ্রাফিতিটি সরিয়ে
নিয়েছে তার ব্যাখ্যা আমরা পাইনি। এখানে ফ্যাসিবাদ বিরোধী সরকার নিজেই স্টুডেন্টস
ফর সভারেন্টির ফ্যাসিস্টদের কাছে পরাজিত হয়েছে, যার লক্ষণ মোটেই শুভ নয়।
হামলায় আহত এক নারীকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সংগৃহিত ছবি |
গতকালের এনসিটিবির সামনে আয়োজিত কর্মসূচিতে স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টির দাবি ছিল: “আদিবাসী সম্বোধন করে কোন বক্তব্য দেয়া যাবে না, কোনে বই পুস্তক ছাপানো যাবে না, লেখালেখি করা যাবে না, কোন নাটক-সিনেমা বা গল্পকাহিন রচনা করা যাবে না। বাঙালিদেরকেই বাংলাদেশের একমাত্র আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি থাকবে। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের (অবাঙালি) ‘আদিবাসী’ বলা ও প্রচারণাকে রাষ্ট্রদ্রোহী অপরাধ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে। (প্রথম আলো, ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ইন্টারনেট সংস্করণ)
স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টির এই বক্তব্য আগাগোড়া ফ্যাসিস্ট। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের সাথে তাদের কোন পার্থক্য কোথায়? হাসিনার সরকারও ক্ষমতায় থাকাকালে ‘আদিবাসী’ শব্দটির ব্যবহার নিষিদ্ধ করে সরকারী নির্দেশ জারি করেছিল, ঢাকা বিমান বন্দরের অভ্যর্থনা কক্ষ থেকে আদিবাসী চিত্র সরিয়ে নিয়েছিল। তবে এক্ষেত্রে শাসকগোষ্ঠীর ভণ্ডামি লক্ষ্য করার মতো: শেখ হাসিনা প্রথমদিকে আদিবাসী দিবসে শুভেচ্ছা বার্তা দিয়েছিলেন, তার সরকারের সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী দীপু মনি ঢাকায় আদিবাসী দিসবের কর্মসূচিতে সশরীরে অংশ নিয়েছিলেন।
সকল দেশে ফ্যাসিস্টদের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো এই – এরা অন্যের গণতান্ত্রিক অধিকারকে স্বীকার করে না এবং বিরুদ্ধ মতকে জোর করে দমন করতে চায়। শুধু তাই নয়, তারা দেশের ভৌগলিক সীমানার মধ্যে অন্য জাতিসত্তার অস্তিত্বকেই স্বীকার করে না এবং বিলুপ্ত করে দিতে চায়। ইউরোপে গত শতকের প্রথমার্ধের শেষ দিকে হিটলারের নেতৃত্বে ফ্যাসিজম চরম ও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল।
বাংলাদেশেও আজ ধর্মীয় ফ্যাসিজমের উত্থানের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এটা জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং সকল জাতিসত্তার নারীর জন্য মোটেই শুভজনক নয়। সরকার যদি অবিলম্বে এদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ না নেয় তাহলে দেশে এই দুর্বল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলো অধিকতর অনিরাপদ হয়ে যাবে।
ঘটনার পর অন্তর্বর্তী সরকারের দুই উপদেষ্টা ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জানান হামলার ঘটনায় দু’জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল লিখেছেন, ‘এই ঘটনার অবশ্যই বিচার হবে।’ অপর উপদেষ্টা মাহফুজ আলম তার ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘ইতোমধ্যে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্য যারা জড়িত, তাদেরও গ্রেপ্তার করা হবে। ঘটনার পূর্বাপর তদন্ত হবে। আর রাজপথে কারো সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি আর চলতে দেয়া যাবে না।’ (প্রথম আলো, ইন্টারনেট সংস্করণ, ১৫ জানুয়ারী ২০২৫)।
”এই ‘সভারেন্টির’ হামলাকারীরা কাদের ‘রেন্ট’ করা?” শিরোনামে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী রাফসান গালিব যথার্থই প্রশ্ন করেছেন: স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টির লোকজন সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্রজনতার কর্মসূচিতে ”শুধু বাধাই দেয়নি, সন্ত্রাসী আচরণই দেখাল। এটি কি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশে থেকে কিংবা তাদের আশকারায় ছাত্রলীগের (নিষিদ্ধঘোষিত) গুন্ডামি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয় না? (প্রথম আলো, ইন্টারনেট সংস্করণ, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫)
আমরা মতিঝিলে সংক্ষুব্ধ আদিবাসী
ছাত্রজনতার ওপর স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টির ফ্যাসিস্ট হামলার তীব্র নিন্দা ও
প্রতিবাদ এবং অবিলম্বে হামলায় জড়িত এই সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আইনগত
পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানাই। ফ্যাসিস্ট বিরোধী আগস্ট অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জন্ম
নেয়া নতুন বাংলাদেশে এদের মতো নব্য ফ্যাসিস্টদের কোন স্থান হতে পারে না। (সমাপ্ত)
* লেখাটি ইউপিডিএফের অফিসিয়াল ফেসবুক
পেইজ থেকে নেওয়া হয়েছে।
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।