এগত্তর চাকমা
শহীদ বিপুল চাকমা, যাকে আমি বিপুল দা নামে চিনি। পার্বত্য চট্টগ্রামের তরুণদের অন্যতম বিপ্লবী আইকন কিংবা তারকা হিসেবে বিপুল চাকমা ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। সদূর পানছড়ি লোগাং করুল্যাছড়ি গ্রাম হতে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের অন্যতম পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছিলেন আমাদের বিপুল দা। হালকা পাতলা শারিরীক গঠনের বিপুল দা ছিলের মিশুক, অমায়িক এবং শাসক ও প্রতিক্রিয়াশীলদের জন্য চির দুর্দমনীয় ব্যক্তিত্ব। প্রতিবাদ-বিক্ষোভ-মিছিলে যার মুখ ব্যারেলের মতো গর্জে উঠতো প্রতিবাদী কন্ঠ হয়ে, যার প্রতিটি জ্বালাময়ী ভাষণে তটস্থ থাকতো শাসকশ্রেণি, বিপুলদা’কে রাতের আঁধারে কাপুরুষের ন্যায় হত্যা করা হয় ১১ ডিসেম্বর ২০২৩ সালের শীতের কনকনে ঠান্ডার মধ্যে।
শহীদ বিপুল চাকমা |
সেনা-ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের মদদপুষ্ট মুখোশ বাহিনীর দুর্বৃত্তরা সেদিন হত্যা করে জুম্ম জাতির তরুণদের অন্যতম আইকন খ্যাত বিপুল দা'কে। তারা সেদিন আমাদের থেকে আরো তিনটি তারকাকে কেড়ে নেয়। সেদিন বিপুল দা’র সাথে শহীদ হন কমরেড লিটন চাকমা, সুনীল ত্রিপুরা ও রুহিন বিকাশ ত্রিপুরা। সেই দিনটির কথা স্মরণ করলে এখনো বুকের মধ্যে তীব্র ব্যথা ও অনুশোচনার সৃষ্টি হয়, যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। শুধুমাত্র একজন রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে নয় বরং বিপুল দা'কে তরুণেরা আইকন বানিয়েছে তার আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বকে, তার আদর্শকে দেখে। একজন উদীয়মান নেতাকে হত্যা করে ঘাতকেরা বুঝতেই পারেনি, তারা বিপুল চাকমাকে নয় পুরো তরুণ প্রজন্মের আইকনকে হত্যা করেছে।
কেন বিপুল চাকমা এতো জনপ্রিয় ছিলেন তরুণদের কাছে সেটা বুঝতে হলে বুঝতে হবে বিপুল দা'কে। প্রজন্ম মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা, প্রসিত বিকাশ খীসা কিংবা সন্তু লারমাকে কাছ থেকে পায়নি, কিংবা তাদের সাথে মিশতে পারেনি। কিন্তু বিপুল চাকমাকে প্রজন্ম কাছ থেকে দেখেছে, তার সাথে মিশেছে, তাকে পেয়েছে নিজেদের সাথে। যার দরুন, তরুণ থেকে শুরু আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলেরই পছন্দের তালিকায় ছিল ‘বিপুল’ দা। একরাশ হাসি, অমায়িক ব্যবহারে মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিতেন চারিদিক।
একই সাথে, গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জনগণই একমাত্র নিয়ামক সেটিকে মাথায় রেখে বিপুল দা' যেন প্রত্যক্ষভাবে সেই কাজে মনোনিবেশ করেছিলেন। তিনি শিখিয়ে ছিলেন পার্টি কিংবা সংগঠন করতে হলে জনগণকে সর্বাধিক সম্মান দিতে হবে। জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হলো পার্টি এবং পার্টিই হলো জনগণ। এই জন্য তিনি মিশে যেতে পেরেছিলেন জনগণের বুকে।
তিনি প্রজন্মের চেতনাকে ধারণ করতে পেরেছিলেন বলেই তাকে সর্বোচ্চ সম্মান ও শ্রদ্ধা দিতে ভুলেনি প্রজন্ম। তিনি যেদিন শহীদ হলেন সেদিন রাত ছিল প্রজন্মের জন্য এক বিভীষিকাময় রাত। পুরো রাত সেদিন প্রজন্ম অপেক্ষায় ছিল বিপুল দা যেন বেঁচে ফিরেন, ঘাতকেরা যেন সফল না হয় এই আশায়।
কিন্তু রাতের আঁধারের পর আসলো বিষন্ন, রিক্ত শূন্য এক শীতের প্রভাত। বিপুল দা'র খোলা চোখের রক্তমাখা ছবি দেখার পর প্রজন্ম নয়নাসিক্ত, কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল সেদিন। রাতের চার তারকার বিদায় যেন মেনে নিতে পারেনি প্রজন্ম ও আপামর জনগণ। যে যেখানে পেরেছে, যে অবস্থানে পেরেছে সেখান হতে প্রতিবাদ, শোক পালন করেছে। সেই জমায়েত, প্রতিক্রিয়া দেখে ঘাতকেরা ভয় পেয়েছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল তারা কাকে হত্যা করেছে। প্রজন্ম এই খুনিদের কখনো ক্ষমা করবে না, করার কথাও নয়।
অন্যদিকে রাষ্ট্র বিপুল চাকমার জনপ্রিয়তাকে ভয় পেয়েছিল। যার কারণে তার পালিত দোসরদের দিয়ে তাকে হত্যার নীল নকশা প্রণয়ন করে। তারা মনে করেছিল বিপুল চাকমাকে হত্যা করে তার আদর্শকে দমন করা যাবে, প্রজন্মের স্পিরিটকে ধ্বংস করা যাবে। কিন্তু তারা ভুলে গেছে যে, বিপুল চাকমা শিখিয়ে গেছেন লড়াইয়ের মাঠে পিছপা হওয়ার জন্য তরুণরা তৈরি হয়নি, তারা তৈরি হয়েছে রাষ্ট্রের দমন-পীড়ন উপেক্ষা করে অধিকার আদায়ের জন্য।
একজন লোকের সুখ, দুঃখ, আনন্দ সবকিছুই ভাগাভাগি করার লোক ছিলেন বিপুল চাকমা। বেলা-অবেলায় যিনি খোঁজ খবর নিতেন তিনি বিপুল চাকমা। রাজনৈতিক দলের উর্ধ্বে তিনি ছিলেন একেকজনের কাছে ছেলে, ভাই এবং বন্ধু। তার রাজনৈতিক দর্শন, আদর্শ, তার জীবনাদর্শন আকর্ষণ করেছিল তরুণ প্রজন্মের কাছে। তিনি প্রয়োজনে সব সময় পাশে থেকেছেন। এমনও দেখা গেছে তিনি তার শত্রুদেরও বিভিন্ন সময়ে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রয়োজনে সহায়তা করে গেছেন। কিন্তু ঘাতকেরা তার মর্ম বুঝতে পারেনি।
বিপুল চাকমা তরুণ প্রজন্মের কাছে একদিনে আইকন হননি। তিনি নিজেকে গড়েছেন, সঁপে দিয়েছেন তরুণদের কাছে। তিনি বরাবরই তরুণ প্রজন্মের স্পিরিটকে সম্মান করেছেন। একজন সাদাসিদা বিপুল দা সারাজীবন আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন।
ঘাতকেরা শুনো, তরুণ প্রজন্ম তোমাদের কোনোদিন এই অপরাধের ক্ষমা করবে না, কোনোদিন না। একদিন এই তীব্র ঘৃণা তোমাদের জন্য করুণ পরিণতি ডেকে আনবে। তোমরা প্রজন্মকে যেভাবে শোকাহত করেছো, সেই শোক একদিন শহীদ বিপুল চাকমার স্পিরিটে পরিণত হবে। একেকজন প্রজন্ম বিপুল হয়ে দেখা দেবে। সেদিন রাষ্ট্র কিংবা ঘাতকদের মাথা নত হতে হবে এবং একদিন বিপুল চাকমার দেখানো পথে হেঁটে প্রজন্ম অধিকার ছিনিয়ে আনবেই।
শহীদ বিপুল
চাকমা, যুগ
যুগ জিও!
লেখক: সাবেক পিসিপি নেতা, খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।