সত্যদ্রষ্টা
[খাগড়াছড়ি ব্রিগেড কমাণ্ডার আব্দুল মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদ-এর সৃষ্ট
নব্যমুখোশ বাহিনী (মোত্তালেব বাহিনী) নিয়ে এ লেখাটি ২০১৮ সালের ১৬ নভেম্বর সিএইচটি
নিউজ ডটকম-এ প্রকাশিত হয়েছিল। সে বছর আগস্ট মাসের ১৮ তারিখ তার
পরিকল্পনায় ও নির্দেশে খাগড়াছড়ি সদরে স্বনির্ভর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল। এ ঘটনার
পরবর্তীতে তাকে খাগড়াছড়ি থেকে অন্যত্র বদলি করা হয়। সম্প্রতি তাকে প্রমোশন দেয়া
হয়েছে বলে জানা গেছে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে লেখাটি এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।]
---------------------------
খাগড়াছড়ি রিজিয়নের সাবেক ব্রিগেড কমাণ্ডার আব্দুল মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদ |
আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাকের ডগায় লোকজনকে হুমকি দিয়ে ব্যাপক
চাঁদাবাজির পর জানা গেল ‘স্বনির্ভর বাজারের খুনীরা’ ১৫ নভেম্বর পানখিয়াপাড়ার
স্কুল মাঠে জড়ো হয়ে স্ফূর্তি করেছে। এও জানা গেছে, তাদের নিরাপত্তায় নির্দিষ্ট দূরত্বে
ছিল পুলিশ ও সেনা জওয়ান। প্রথম দিকে তারা ‘নব্য মুখোশবাহিনী’ নামে পরিচিতি
পেলেও স্বনির্ভর বাজার হত্যাকাণ্ডের (১৮ আগস্ট) পর তাদের প্রকৃত পরিচয় উঠে এসেছে,
আসলে তারা হলো ‘মোত্তালেব বাহিনী’। খাগড়াছড়ি
রিজিয়নের (২০৩ পদাতিক ব্রিগেড) আব্দুল মোত্তালেব সাজ্জাদের প্রত্যক্ষ নির্দেশনা ও
পরিচালনায় এ ঠ্যাঙ্গারে বাহিনী গঠিত হয়েছে। তার জামাত ঘেঁষা ও ঘোরতর সাম্প্রদায়িক
মনোভাব খাগড়াছড়িতে সর্বজনবিদিত। জঙ্গী ও পাকিস্তানের আইএসআই-এর সাথে তার সম্পৃক্ততা
নিয়েও কানাঘুষা রয়েছে। স্বনির্ভরবাজারে নারকীয় হত্যাকাণ্ডের মিশন সম্পন্ন করে সন্ত্রাসীদের
গড ফাদার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোত্তালেব খাগড়াছড়ি থেকে বদলী হলেও, তার সৃষ্ট ঠ্যাঙ্গারে
বাহিনী আগের মতোই নিরাপত্তা বাহিনীর প্রত্যক্ষ আশ্রয়-প্রশ্রয়ে সন্ত্রাসী
কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রত্যক্ষদশীর্রা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, গতকাল শনিবার
মোত্তালেব বাহিনী প্রাণের ভয় দেখিয়ে আশ-পাশের তেঁতুলতলা,
হরিনাথপাড়া ও কমলছড়ি থেকে শতাধিক লোকজনকেও উক্ত স্কুল মাঠে যেতে বাধ্য করেছে। সেনা
বেতনভুক নিম্নমানের কতিপয় আঞ্চলিক নিউজ ওয়েবপোর্টাল ছবিসহ এ খবর তুলে ধরেছে, এতে
বোঝা যায় তা ছিল সেনা গোয়েন্দা চক্রের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ। হলুদ সাংবাদিকতায়
আক্রান্ত একশ্রেণীর তথাকথিত সংবাদদাতাদের কাছে এসব বেশ উপজীব্যও বটে। এখানে সবচে’ মজার ব্যাপার
হচ্ছে, ঠিক কী অনুষ্ঠান, সে সম্পর্কে আয়োজকদের নিজেদেরও কোন ধারণা নেই সেটি স্পষ্ট
হয়েছে। একই সাথে তাদের মদদদাতাদের বিদ্যার বহরও উন্মোচিত হয়েছে। বলা যায় উক্ত অনুষ্ঠানের
মাধ্যমে তাদের অজ্ঞতা ও দৈন্যদশা করুণভাবে প্রকাশ পেয়েছে, এক কথায় ‘হাটে হাঁড়ি ভেঙেছে।’ আসলে অপরাধী
যত সূক্ষ্মভাবেই করতে চেষ্টা করুক, তার অপকর্মের ছাপ রেখে যায়।
সন্ত্রাসী গড ফাদাররা এ ঠ্যাঙ্গারে বাহিনীকে দিয়ে রাজনৈতিক অনুষ্ঠান
করাতে চেয়েছিল। পোস্টার-বুকলেট ছেপে প্রচারসহ এ পর্যন্ত মোত্তালেব
বাহিনীকে দিয়ে খুন, অপহরণ ও চাঁদাবাজি করাতে পারলেও কোনভাবেই এদের রাজনৈতিকভাবে মাঠে
নামাতে সক্ষম হচ্ছিল না, এটাই ছিল মাথা মোটা পাকিস্তানপন্থী সেনা কর্মকর্তাদের বড়
ব্যর্থতা। আজ পর্যন্ত কোথাও মোত্তালেব বাহিনীর পাণ্ডাদের দিয়ে জনসভা করানো যায় নি।
করতে পারার কথাও নয়। শ্যামল কান্তি (জোলেইয়্যা) ওরফে তরু হলো ইউপিডিএফ থেকে নানা
অপরাধে বহিঃষ্কৃত বলতে গেলে একেবারে নিম্নস্তরের কমীর্। তাদের সাথে যারা জুটেছে, জোলেইয়্যা
তরুকে দেখেই বাকীদের অবস্থা বুঝে নিতে হবে, ‘হাঁড়ির সব ভাত
টিপতে হয় না’। সেনা আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এরা
খুন-খারাবি করছে,
ঘন ঘন ব্রিগেড-জোন-ক্যাম্পে গিয়ে
মিটিং করছে। জানা যায়, ইউপিডিএফ নেতৃত্ব জোলেইয়্যা (তরু)-বর্মা তথা কমীর্দের
গড়ে তুলতে বহু প্রচেষ্টা চালিয়েছে। পার্টিতে নিরক্ষর ও স্বল্প শিক্ষিতদের লেখাপড়া
শেখানোর ব্যবস্থা করেছে, রাজনৈতিক ক্লাশসহ নানা প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের উপযুক্ত করতে
চেয়েছে। কিন্তু তরু-বর্মাদের মানুষ কিংবা কমীর্ হিসেবে গড়ে
তোলা যায় নি। ভেড়া ছাগল ইত্যাদি দিয়ে তো আর হাল চাষ হয় না, শ্রম পণ্ড হয় মাত্র।
বাংলা প্রবাদে আছে, ‘গামছারও শখ হয়
ধোপার বাড়ি যাবার’। মাথা মোটা সেনা কর্মকর্তারা পোস্টার
ছেপে শ্যামল কান্তি জোলেইয়্যা (তরু)-এর মতো লোক দিয়ে রাজনৈতিক অনুষ্ঠান করাতে গিয়ে
লেজেগোবরে হয়ে পড়েছে। তাদের পোস্টারটি তারা রঙিন করতে রঙের কোন কার্পণ্য করে নি।
কিন্তু পোস্টারের যে ভাষা তা খেয়াল করে দেখলে তাদের রাজনৈতিক জ্ঞান কোন লেভেলের, তা বোঝা যায়। পোস্টারের মাঝখানে উল্লেখ রয়েছে
“প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী
সফল হোক” আবার নিচে “সম্মেলন সফল করুন”-- তাহলে ঠিক কী
“অনুষ্ঠান” তারা করেছে,
সেটা “প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী” না “সম্মেলন” না গড ফাদারদের
মনোরঞ্জনের জন্য ফরমায়েশি অনুষ্ঠান? “প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী” আর “সম্মেলন” কী সেটা শ্যামল
কান্তি জোলেইয়্যা (তরু)-রা জানবে কোত্থেকে, তারা তো আর ইউপিডিএফ-এর সে স্তরের
কমীর্ ছিল না। আর তাদের মদদদাতাদের লেফট—রাইট করতে করতে
বুদ্ধি হাঁটুর নিচে নেমে গেছে, রাজনৈতিক কর্মসূচি ও পরিভাষা নিয়ে তারা চিন্তা করে
না, পার্বত্য চট্টগ্রামের অখণ্ডতা রক্ষার নামে তারা গুণ্ডামি মাস্তানি করে। কিন্তু
যারা প্রকৃত রাজনৈতিক কমীর্, বা যাদের রাজনৈতিক দৃষ্টি আছে, এসব ব্যাপার তাদের নজরে
পড়বে। দালালদেরও এত আকাল, ‘প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী’ ও ‘সম্মেলন’ গুলিয়ে-ফেলা লোককে দিয়ে
অনুষ্ঠানের পৌরহিত্য করাতে হয়। আর শ্যামল কান্তি জোলেইয়্যা তরুদের জাতে তুলতে উক্ত
অনুষ্ঠানে “প্রধান অতিথি”র কলঙ্ক তিলক
পরলেন মহালছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান বিমল কান্তি চাকমা, তাতে অবাক হবার কিছু নেই। কথায়
বলে, ‘রতনে রতন চেনে......।’
পোস্টারের শীর্ষে বামের কোণায় রয়েছে তাদের আসল কথাটি “ইউপিডিএফ (প্রসিত
পন্থী) খুনী সন্ত্রাসী দলকে নির্বাচনে নিষিদ্ধ করা হোক”। তাদের এই মনোবাঞ্ছার
মধ্যেই তাদের শিকড় তথা পরিচয় অন্তনির্হিত আছে।
পোস্টারে তারা যা বলতে পারে নি পানখিয়াপাড়া স্কুল মাঠে মোত্তালেব বাহিনীর
পাণ্ডারা তা খোলসা করে বলে ফেলেছে “যে দল পার্বত্য
চুক্তি বাস্তবায়ন করবে, সে দলকে ভোট দিতে হবে”-- এখানেও তাদের
জোরজবরদস্তি পরিচয় ফুটে উঠেছে এবং এটিই হচ্ছে তাদের গড ফাদারদের আসল মতলব। মোত্তালেব
বাহিনী গঠনের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত পদস্থ সেনা কর্মকর্তা কর্তৃক শেখ হাসিনাকে
পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি সংসদীয় আসন উপহার দেয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করার কথা আজ
আর অজানা বিষয় নয়। দেশবাসীকে অনুরোধ করব প্রকৃত ঘটনা এবং এর পরম্পরা বুঝতে চাইলে
এসব বিষয় লক্ষ্য করুন (পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ ভুক্তভোগী বলে মুখ খুলতে না পারলেও
তাদের এসব জানা)।
১৮ মার্চ কদুকছড়ি থেকে অপহৃত হিল উইমেন্স ফেডারেশনের দুই কমীর্ মন্টি
ও দয়াসোনাকে মোত্তালেব বাহিনী ভয় দেখিয়ে ইউপিডিএফ ছাড়তে লিখিত অঙ্গীকার নেয়ার
পাশাপাশি সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত চুপচাপ থাকতে পরামর্শ দেয়। অপহরণদশা থেকে মুক্ত হয়ে
ঢাকায় অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে মন্টি-দয়াসোনার এ সংক্রান্ত
বক্তব্য জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দৈনিকে প্রকাশিত হয়। সমস্ত কার্যকলাপ যে আসন্ন একাদশ
সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হচ্ছে এবং কারা মোত্তালেব বাহিনীকে দিয়ে এসব
করাচ্ছে, তা আর বোঝার বাকী নেই।
লক্ষ্য করবার বিষয়, শ্যামল কান্তি জোলেইয়্যা তরুরা গড ফাদারদের শেখানো
বুলি আউড়িয়ে ইউপিডিএফ-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিল “স্বৈরাচারি” “সন্ত্রাসী” “জনবিচ্ছিন্ন”...ইত্যাদি ইত্যাদি।
যুক্তির খাতিরে যদি ধরেও নেয়া হয় যে, ইউপিডিএফ আসলে “স্বৈরাচারি” “সন্ত্রাসী” আর “জনবিচ্ছিন্ন”। তাহলে এ দলকে
“নির্বাচনে নিষিদ্ধ
করার” দরকার কী? জনগণের
রায়ই তো প্রমাণ দেবে। নির্বাচনই তো যাচাইয়ের পরীক্ষা। কিন্তু তা না, দণ্ডমুণ্ডের
কর্তাদের মতলব অন্যখানে।
আরও লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, শাসকচক্র অন্যান্য সংগঠনসমূহকে বাগিয়ে
নিতে পারলেও একটি দলকে তা করতে পারে নি। সেটি হচ্ছে পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলনরত
ইউপিডিএফ, যেটি বর্তমান সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের শেষ ভরসাস্থল। সে কারণেই
ইউপিডিএফ সরকার তথা প্রতিক্রিয়াশীল গণশত্রুদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। ইউপিডিএফ’কে আঁতুড় ঘরে
গলা টিপে ধ্বংস করার চেষ্টাও কম হয় নি। আড়াই শ’র উপরে নেতা-কর্মী-সমর্থক
এ দল থেকে শহীদ হয়েছে। জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক
ইতিহাসে এত বিপুল সংখ্যক আত্মবলিদান অন্য কোন দলের নেই। মামলা-হুলিয়া-জেল-জুলুম-দমন-পীড়ন কোন কিছুতে
এ দলের নেতা-কমীর্রা দমে যায়নি।
যখন কোন দলকে আঘাত করে পরাস্ত করা যায় না, তখনই তার বিরুদ্ধে চলে ষড়যন্ত্র
চক্রান্ত। এর অংশ হিসেবে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে ইউপিডিএফ-এর সংগঠনের নাম,
প্রতীক, পতাকা-ইত্যাদি জালিয়াতি শুরু হয়েছে। মোত্তালেব বাহিনী যদি
“১৫ নভেম্বর”-কে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী
পালন করে, তাহলে ইউপিডিএফ-এর নাম কেন ব্যবহার করছে? ইউপিডিএফ-এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী
তো ২৬ ডিসেম্বর। ইউপিডিএফ-এর প্রতীক, পতাকা ব্যবহার করার অধিকার
তাদের নেই।
হাস্যকর ব্যাপার আরও এই, মোত্তালেব বাহিনী পানখিয়াপাড়ার স্কুল মাঠের
অনুষ্ঠানে বেশ জ্ঞানগর্ভ কথাও উচ্চারণ করেছে “পূর্ণস্বায়ত্তশাসন
আইনে নেই, রাষ্ট্র দেবে না”-- ইত্যাদি ইত্যাদি (‘পূর্ণস্বায়ত্তশাসন
বইয়ে নেই’ এমন কথাও নতুন নয়)। শ্যামল কান্তি জোলেইয়্যা তরুকে
জিজ্ঞেস করি ‘বাংলাদেশের সংবিধানের প্রচ্ছদ পাতাটি কেমন- লাল না কালো?
পাকিস্তানের সংবিধানে কি বাঙালি জনগণের অধিকার দেবার কথা লেখা ছিল?
বেঈমানির দলে এ যাবৎ অনেকে নাম লিখিয়েছে, কেউই টেকে নি, বিনাশ হয়েছে।
শ্যামল কান্তি জোলেইয়্যা তরু নিজেই একান্ত সাক্ষাতে জানিয়েছে, ‘মোত্তালেব বাহিনীতে’ ঢুকে জীবনে বড়
রকমের ভুল করেছে। এখন টিকতেও পারছে না, বেরুতেও পারছে না। তাদের পুরো নিয়ন্ত্রণ এখন
সেনা গোয়েন্দা আর তাতিন্দ্রলাল পেলের হাতে। এমন অনেক কিছু হচ্ছে, যা শ্যামল কান্তি
জোলেইয়্যা তরুদের নামে হলেও তারা নিজেরা সে সব ঘটনায় জড়িত নয়। অথচ তাদের নামেই
বিভিন্ন খুন-খারাবি সংঘটিত হচ্ছে। নিজেদের কার্যসিদ্ধি হলে এমন
দিন আসবে, সেনা গোয়েন্দারা তাদের আখের ছোবড়ার মতো ছুঁড়ে ফেলে দেবে।#
(১৬ নভেম্বর ২০১৮)
সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।