""

‘বাঙালি-পাহাড়ি সংঘর্ষের’ রাজনীতি

খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় বিজিবির একটি ক্যাম্প স্থাপনের প্রতিবাদে স্থানীয় ভূমি রক্ষা কমিটির বিক্ষোভ মিছিলে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। ছবিটি ২০১৫ সালের ১৫ মার্চ তোলা। সৌজন্য ডেইলি স্টার বাংলা


উছাছা এ চাক

'জাতিগত সংঘাত' শব্দবন্ধের ব্যবহার সহিংসতাকে মানুষের জাতিগত পরিচয়ের স্বভাবজাত বলে ধারণা দেয়। অন্যভাবে বলতে গেলে এটি এমন একটি ধারণা তৈরি করে, যাতে মনে হয় সহিংসতা মানবজাতির আদিম বা অন্তর্নিহিত বিভেদ থেকে সৃষ্ট।

খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় বিজিবির একটি ক্যাম্প স্থাপনের প্রতিবাদে স্থানীয় ভূমি রক্ষা কমিটির বিক্ষোভ মিছিল। তাদের দাবি, আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা জমিতে ক্যাম্পটি বসানো হয়েছে। ছবিটি ২০১৫ সালের ১৫ মার্চ তোলা। ছবি: কফিল মাহমুদ

পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান ঘটনাগুলোর ব্যাপারে দেশের মূলধারার গণমাধ্যমগুলো বেশিরভাগ ঠিকঠাক তথ্য দেয় না, দিলেও তা হয় পক্ষপাতদুষ্ট বা অপেশাদার। পার্বত্য অঞ্চলের যেকোনো সংঘাতের ঘটনায় কোনো ধরনের প্রাথমিক তথ্যানুসন্ধান ছাড়াই তারা একে 'পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষ' বলে চালিয়ে দেয়।

গত ১৮ সেপ্টেম্বরের কথাই ধরা যাক। ওইদিন খাগড়াছড়িতে হামলা-পাল্টা হামলার সূত্রপাত হিসেবে মামুনের মৃত্যুর ঘটনাকে কারণ হিসেবে বর্ণনা করা হয় (যে মোটরসাইকেল চুরি করতে গিয়ে গণপিটুনির শিকার হয়ে এবং/অথবা লাঠিপেটা হয়ে মারা যায়)।

এখন পর্যন্ত মামুন হত্যাকাণ্ডের ঘটনার তদন্ত শেষ হয়নি যা থেকে জানা যাবে মামুন কিভাবে মারা গেছেন, বা কারা তাকে হত্যা করেছেন, বা আর কী ঘটেছিল যার ফলে ৫০টির মতো ঘরবাড়ি আর দোকানপাটে আগুন দেওয়া হলো। বরং আমরা জানলাম, এটা মূলত 'পাহাড়ি-বাঙালি দ্বন্দ্বের' কারণে ঘটেছে। আরও ভয়াবহ যে, আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে ঘটনার তদন্ত আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) একটা 'অনুসন্ধানী বিবৃতির' মাধ্যমেই শেষ হয়েছে।

ওইদিন আসলে কী হয়েছিল, তা আমার লেখার উপজীব্য নয়। আমি আপনাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই কোনো আক্রমণ-সংঘাতের ঘটনার বর্ণনায় 'পাহাড়ি/আদিবাসী জনগণ ও স্থানীয় বাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষ' অথবা 'পাহাড়ি-বাঙালি দ্বন্দ্ব' শব্দবন্ধের প্রয়োগের বিষয়টির উপরে।

প্রথমত, এসব শব্দবন্ধের গণব্যবহার মানুষের জাতিগত পরিচয় নিয়ে যে বদ্ধমূল ধারণাগুলো আছে তার ওপর ভিত্তি করে সত্যিকারের যে বিদ্রোহ-সংগ্রামের ঘটনা ঘটে, সেগুলোকে সরল সমীকরণে দাঁড় করায়। 'বাঙালি-পাহাড়ি দ্বন্দ্ব' শব্দগুচ্ছ মূলত ইংরেজি এথনিক কনফ্লিক্ট বা 'জাতিগত সংঘাত'-এর পারিভাষিক রূপ। সমাজবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় জাতিগত সংঘাত বা সংঘর্য বলতে এমন দুই বা ততোধিক পক্ষের মধ্যে রাজনৈতিক বা সামাজিক সংঘর্ষকে বুঝায়, যাদের জাতিগত পরিচয় চিহ্নিত। কিন্তু প্রায়শই জাতিগত সংঘাত বলা হলেও তা সত্যিকার অর্থে জাতিগত সংঘাত না। রুয়ান্ডা থেকে ভারত পর্যন্ত এমন বহু ঘটনাকে 'জাতিগত সংঘাতের' তকমা দেওয়া হয়েছে কিন্তু মূলত তা ছিল রাজনৈতিক সংঘাত।

'জাতিগত সংঘাত' শব্দবন্ধের ব্যবহার সহিংসতাকে মানুষের জাতিগত পরিচয়ের স্বভাবজাত বলে ধারণা দেয়। অন্য কথায় বলতে গেলে এটি এমন একটি ধারণা তৈরি করে, যাতে মনে হয় সহিংসতা মানবজাতির আদিম বা অন্তর্নিহিত বিভেদ থেকে সৃষ্ট। ফলে মানুষ ধরে নেয় এগুলো খুব স্বাভাবিক ঘটনা; অথচ যা মারাত্মক এক সমস্যা। কারণ যখন সংঘাতের এসব ঘটনাকে সরল করে উপস্থাপন করা হয়, তখন ন্যায়বিচারের প্রশ্নকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়। প্রকৃত অপরাধীরা নামহীন, পরিচয়হীন 'মব' হিসেবে আড়ালে থেকে যান।

বলছি না সহিংসতার পেছনে জাতিগত বা পরিচয়গত কারণগুলোকে পাশ কাটিয়ে যেতে হবে। কিন্তু এসব পরিভাষা সহিংসতার পেছনের যেসব মূল ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক কারণগুলো থাকে, সেগুলোকে খুব ছোট করে ফেলে। তাছাড়া, এই সেটেলার বাঙালি-পাহাড়ি বাইনারি যে রাষ্ট্র কর্তৃক উদ্দেশ্যমূলকভাবে নির্মিত এক ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবিচার, এই প্রকৃত সত্য থেকে এসব শব্দবন্ধ আমাদের দৃষ্টি সরিয়ে দেয়।

বাস্তবে পাহাড়ি বা আদিবাসী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মানুষ আর সেটেলার বাঙালি উভয়ই রাষ্ট্রীয় এই প্রহসনের ভুক্তভোগী। ঔপনিবেশিক সময় থেকেই 'বন রক্ষা' আর 'উন্নয়নের' নামে বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রীয় নীতি আর আইনের অধীনে পাহাড়িরা নিজেদেরকে এক কাঠামোগত সহিংস পরিস্থিতিতে আবিষ্কার করে — যে প্রবণতা ঔপনিবেশিকোত্তর পাকিস্তান এবং পরে বাংলাদেশও আরও তীব্রভাবে অনুসরণ করে চলেছে।

বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রে পাহাড়িরা নতুন ধরনের নিপীড়নের মুখোমুখি হয় বাঙালি জাতীয়তাবাদের আগ্রাসনে যা পার্বত্য চট্টগ্রামের সামরিকীকরণ এবং ৮০'র দশকে রাষ্ট্রীয় মদদে পাহাড়ে সমতলের মানুষদের স্থানান্তর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে স্থায়ী রূপ পায়। অন্যদিকে, সমতল থেকে যেসব ভূমিহীন বা নদী ভাঙনের শিকার বাঙালিদের জমির মালিকানার প্রতিশ্রুতি এবং মাসিক ভাতা দিয়ে সেখানে স্থানান্তর করা হয়েছে, তারাও নিজেদের আবিষ্কার করে অচেনা এক ভৌগলিক দৃশ্যপটে এবং নতুন এক বাস্তবতায়।

তারা দেখলো, যে জমি দেওয়ার জন্য তাদেরকে রাষ্ট্রীয় প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তা কেবলই জোর জবরদস্তি করে আদায় করতে হয়। কারণ এখানে আগে থেকেই অন্যরা বসবাস করছে আর জমিগুলো এমন মানুষদের ভোগদখলে যারা দেখতেও ভিন্ন। তাদের এই বঞ্চনা থেকে জেগে ওঠা ক্ষোভের প্রকাশ প্রায়শই ভুল প্রতিপক্ষের উপর গিয়ে পড়ে। এই অঞ্চলটিকে যারা নিয়ন্ত্রণ করছেন তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে এই বঞ্চনার অনুভূতিগুলো ঘৃণায় পরিণত হয় আর সময়ে সময়ে তার সহিংস বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

মিডিয়া এই ঘটনাগুলো বেশিরভাগ সময় 'পাহাড়ি-বাঙালি/সেটেলার বাঙালি সংঘর্ষ' হিসেবে চিত্রায়ণ করে অথবা কিছু ক্ষেত্রে 'বাঙালি-পাহাড়ি সংঘর্ষ/সহিংসতা' হিসেবে প্রচার করে দুটো পরস্পরবিরোধী জাতিগত পরিচয়কে চিহ্নিত করে। পাশাপাশি ইঙ্গিত করে যে, 'পাহাড়িরা' সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটিয়েছে।

বাস্তব জীবনে এই শব্দগুলো কি প্রভাব ফেলে, তা ব্যাখ্যা করতে 'দন্তন্য'-এর গল্প বলি। দন্তন্যকে চিনি ২০১৩ সাল থেকে। তার বয়স এখন ৩০-এর কোঠার শেষের দিকে। শৈশবের স্মৃতিগুলো প্রায় প্রতি রাতে তাকে ঘুমের মধ্যে তাড়া করে। তাদের পরিবার একাধিকবার 'সেটেলার' আর রাষ্ট্রীয় বাহিনীর যৌথ আক্রমণের মুখে উচ্ছেদ হয়েছে। নব্বইয়ের দশকে একবার তাদের ভারত সীমান্তের কাছের এক শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে হয়, যা ছিল একটি শ্মশানের ঠিক পাশে।

খুব কাছ থেকে সে দেখেছে আগুন কিভাবে মৃতদেহ পোড়ায়। দন্তন্য প্রায় প্রতিদিন কাউকে না কাউকে চিতায় উঠতে দেখে। কেউ পালানোর সময় আহত হয়ে, কেউবা শারিরীক দুর্বলতায়, অনাহারে বা শিবিরের বিশ্রি পরিবেশে আরও কোনো ভয়াবহ রোগে ভুগে মারা যায়। পোড়া মাংসের গন্ধ তার নিজের চামড়ার মতোই চেনা।

দন্তন্যর মতো '৮০র দশক থেকে জ্বালাও-পোড়াও, লুটপাট, হত্যা, ধর্ষণসহ নানাবিধ রাষ্ট্রীয় কাঠামোগত সহিংসতার শিকার হাজারো আদিবাসী নারী-পুরুষের ভয়াবহ অভিজ্ঞতাগুলোকে বড্ড সহজীকরণ করে ফেলে 'পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষ' শব্দবন্ধ।

এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, আমাদের মা-বাবারা, তাদের পূর্বসূরিরা যে সমাজে বড় হয়েছেন, সেটি কোনো কল্পনার স্বর্গরাজ্য। তাদের যেসব গল্প আমরা শুনি, তাতে বোঝা যায় যুগ যুগ ধরে সংগ্রাম তাদের নিত্যসঙ্গী। জুম চাষকে ঘিরে তাদের কষ্টের দিনগুলো, অল্প বয়সে মারা যাওয়া, সামাজিক নানান বাস্তবতা, প্রতিশোধপরায়ণতা, পারিবারিক টানাপোড়েন, আর পিতৃতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে নারীদের সংগ্রাম—এগুলো তো ছিলই। কিন্তু এই বাঙালি-পাহাড়ি মেরুকরণের আগে যা ছিল না, সেটা হচ্ছে হিংস্র জনতার দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ভয়; ধর্ষণ আর অপহরণের ভয় এবং জাতিগত পরিচয়ের ভিন্নতার ভিত্তিতে অপমানের মুখোমুখি হওয়ার ক্রমাগত উদ্বেগ।

ফলশ্রুতিতে, এই নতুন নতুন হুমকিগুলো আদিবাসীদের নতুনতর কাঠামোগত ও প্রাত্যহিক ঝুঁকি তৈরি করছে। এটাও বলার দরকার যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের সব পাহাড়ি বা সব বাঙালির মধ্যেই যে বৈরি সম্পর্ক তা ভাবার কোনো কারণ নেই। আবার সব পাহাড়ি বা সব বাঙালি পরিচয়ের দিক থেকে বা সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থানগতভাবে এক, তাও ভাবার অবকাশ নেই।

বরং মূলধারার গণমাধ্যমগুলো 'বাঙালি-পাহাড়ি' শব্দবন্ধের প্রতি অতি গুরুত্ব আরোপ করে একদিকে মুখোশের আড়ালে অপরাধীদের লুকিয়ে থাকতে সহায়তা করে তাক্ষণিক বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় মদদে সেটেলার বাঙালি ও পাহাড়ি দুটি আলাদা শ্রেণির জাতিকরণের ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকেও আড়াল করে। গণমাধ্যমগুলো এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো তুলতে ব্যর্থ হয়েছে যে, এই 'দ্বন্দ্বগুলো' থেকে কারা উপকৃত হয় এবং কিভাবে এর সূত্রপাত হয় আর ছড়িয়ে পড়ে।

আমরা আদিবাসীরা এই প্যাটার্নটা খুব ভালো করেই জানি। আমরা জানি কিভাবে পৃথিবীর যে কোনো কিছুকে গুজবে পরিণত করে আদিবাসীদের উপর আক্রমণের 'বৈধতা' উপাদন করা যায়। অন্যদিকে মূলধারার গণমাধ্যমগুলো এসব আক্রমণকে 'পাহাড়ি-বাঙালি' সংঘাত হিসেবে চালিয়ে দেয়, অপরাধীরা নির্বিঘ্নে পার পেয়ে যায়।

উছাছা এ চাক একজন গবেষক, এক্টিভিস্ট এবং লোকায়ত বিদ্যালয়ের একজন যুগ্ম আহ্বায়ক

অনুবাদ করেছেন আসিফুর রহমান


* সৌজন্যে : ডেইলি স্টার বাংলা



সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।







0/Post a Comment/Comments