ঢাকা, সিএইচটি নিউজ।। মার্কসবাদী রাজনীতিবিদ, লেখক ও জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি কমরেড বদরুদ্দীন উমরের ৯০তম জন্মবার্ষিকী পালন করা হয়েছে।
জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে গতকাল ২০ ডিসেম্বর ২০২১, সোমবার ‘ফ্যাসিবাদ ও সাম্রজ্যবাদ বিরোধী কমিউনিস্ট বিপ্লবী কমরেড বদরুদ্দীন উমরের ৯০তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় কমিটি’র উদ্যোগে দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়। সকাল ১১টা থেকে বেলা সাড়ে ৩টা পর্যন্ত বদরুদ্দীন উমরের লেখা বই ও ছবি প্রদর্শন করা হয়। বিকাল ৪টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক মোজাফফর চৌধূরী মিলনায়তনে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
“কমরেড বদরুদ্দীন উমর এবং ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ” শীর্ষক আলোচনা সভায় জন্মবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক ও জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকিম-এর সভাপতিত্বে ও শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-জনতা ঐক্যের আহ্বায়ক আমির আব্বাসের সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন প্রকৌশলী শেখ মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক, সাবেক অধ্যাপক আকমল হোসেন, লেখক শিবিরের সভাপতি হাসিবুর রহমান, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি খালেকুজ্জামান, গণমুক্তি ইউনিয়নের সমন্বয়ক নাসির উদ্দিন আহম্মদ নাসু, লেখক সৈয়দ আবুল কালাম, বাংলাদেশ সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক ডা. আব্দুল হাকিম, কৃষক ও গ্রামীণ ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের চট্টগ্রাম অঞ্চলে সমন্বয়ক এ্যাড. ভূলন ভৌমিক, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি মিতু সরকার ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদে সাংগঠনিক সম্পাদক অমল ত্রিপুরা।
সভায় অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, বদরুদ্দীন উমরের মধ্যে সব সময়ই এমন চিন্তা ছিল যে পৃথিবীতে বিদ্যমান অবস্থার চেয়ে অনেক ভালো অবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। তাঁর পিতা আবুল হাশিম মুসলিম লীগের অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। বদরুদ্দীন উমর প্রথম জীবনে তাঁর বাবা আবুল হাশিমের দ্বারা প্রভাবিত ও পরিচালিত হয়েছেন। প্রথমেই তিনি ‘ইসলামের মর্মবাণী’ নামে একটি পুস্তিকা রচনা করেছিলেন। মুসলিম লীগের রাজনীতিটা তিনি নিজের পারিবারিক অবস্থা থেকেই দেখেছেন। এর ফলে সাম্প্রদায়িকতা কী, তা বদরুদ্দীন উমরের চেয়ে ভালো করে অন্য কেউই বোঝেননি।
তিনি আরো বলেন, বদরুদ্দীন উমর ‘সাম্প্রদায়িকতা’ নামে যে বই ও প্রবন্ধ লিখেছিলেন, সেই ছোট তিন-চারটি লেখা পাকিস্তানের আদর্শগত ভিত্তি একেবারে খ-ন করে দেয়। ছয় দফা আন্দোলন শুরু হওয়ার আগে তিনি এই লেখাগুলো লিখেছিলেন। লেখাগুলো খুব প্রভাবশালী হয়েছিল। এই লেখার আগেই হয়তো তিনি নিজের পিতার মত সম্পূর্ণ ত্যাগ করে গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্রের দিকে আকৃষ্ট হয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘বদরুদ্দীন উমর পরিপূর্ণ জীবন যাপন করেছেন। প্রথম দিকে তিনি যখন বামপন্থী রাজনীতিতে আসেন, তখন দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমালোচনা করেন। বামপন্থী আন্দোলনকে সঠিক ধারায় নিতে মার্ক্সবাদী ধারার সামনের সারির অনকেই উমরের চিন্তায় আকৃষ্ট হয়েছেন। একপর্যায়ে মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী দলে যুক্ত হওয়ার পর কমরেড তোয়াহা, আবদুল হকসহ অনেকেই বলতে চেয়েছেন, উমর তো বুদ্ধিজীবী; কমিউনিস্ট রাজনীতি করতে হলে মন-মানসিকতার অনেক পরিবর্তন দরকার, মাঠে কাজ করা দরকার। এভাবে তাঁরা উমরকে পার্টির নেতৃত্বে গ্রহণ করতে চান নি। বরং তিনি যাতে নেতৃত্বে আসতে না পারেন, সেই চেষ্টা করেছেন। আমাদের কাছে মনে হয়েছে, একজন মেধাবী ও প্রতিভাবান মানুষকে যতটুকু মূল্য দেওয়া উচিত, গোটা বামপন্থী রাজনীতি থেকে উমর তা পাননি।’
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান বলেন, ‘বদরুদ্দীন উমরের সব লেখার সঙ্গে আমরা একমত না–ও হতে পারি। কিন্তু এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা তাঁর দ্বারা সমৃদ্ধ হয়েছেন। তাঁর কাছে বামপন্থী আন্দোলনের অনেক প্রত্যাশা ছিল। সেই প্রত্যাশা তিনি পূরণ করতে পারেননি। সেই দায় তাঁর একার নয়। আমরা বামপন্থীরাও তাঁকে সেই ভূমিকায় নিয়ে আসার দায়িত্ব পালন করতে পারিনি। তবে প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারলেও বদরুদ্দীন উমর তাঁর জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বামপন্থীদের মর্যাদা ও সম্মান রক্ষা করেছেন।’
এ সময় তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘বদরুদ্দীন উমর সত্যিকারের শুদ্ধ বাম রাজনীতির পতাকা তুলে ধরেছেন। বংশপরিচয়, শিক্ষা, চিন্তাচেতনার দিক থেকে অভিজাত হলেও তাঁর মন পড়ে আছে শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের মঙ্গল কামনায়।’
আলোচনা সভায় ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় কমিটির সভাপতি আকমল হোসেন বলেন, বদরুদ্দীন উমর একজন মার্ক্সবাদী রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী। জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে তিনি তথাকথিত বিত্ত ও সামাজিক প্রতিপত্তি লাভ করতে পারতেন। সমাজের ভেতর থেকে লাভটা বের করে এনেও সামনে আবার প্রতিষ্ঠানবিরোধী অবয়ব নিয়ে থাকতে পারতেন, কিন্তু তিনি এ কাজ করেননি।
বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সভাপতি হাসিবুর রহমান অভিযোগ করে বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন নির্বাচন বলতে কিছু নেই। শুধু জাতীয় সংসদ নয়, কোথাও কোনো নির্বাচন হওয়ার বাস্তবতা বা সুযোগ নেই। এই রাষ্ট্র কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক হতে পারে না। এই ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে বদরুদ্দীন উমর পাঠ জরুরি।’
জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকিম বলেন, বদরুদ্দীন উমর কার্ল মার্ক্সের একজন শিষ্য হিসেবে মার্ক্স-লেনিনের চিন্তাকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। বাংলাদেশ, এমনকি উপমহাদেশে এ ধরনের দৃষ্টান্ত বিরল।
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদে নেতা অমল ত্রিপুরা বলেন, বদরুদ্দীন উমর পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে সংখ্যালঘু জাতিসত্তাদের নিপীড়ন-নির্যাতন কথা বলে আসছেন। তিনি পাহাড়ে নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকে অনেক লেখা লিখেছেন। এ বিষয়ে তাঁর সম্পাদিত “পার্বত্য চট্টগ্রাম: নিপীড়ন ও সংগ্রাম” নামে একটি বইও রয়েছে। ২০০৩ সালে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল গঠনের মধ্যে দিয়ে আমরা তাঁর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে সারাদেশে নিপীড়িত জাতিসমূহের মুক্তির লক্ষে একসাথে আন্দোলন করে যাচ্ছি।
তিনি আরো বলেন, ৯০ দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগণের ওপর শাসকগোষ্ঠী নিপীড়ন চালালে দেশের প্রগতিশীল লেখক, সাংবাদিক, রাজনীতি দলের নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষেরা সোচ্চার ছিলেন, আমাদের সাথে আন্দোলন সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। একটা সময়ে এসে অনেকে সেখান থেকে সরে দাঁড়ালেও কমরেড বদরুদ্দীন উমর সরে দাঁড়াননি, পাহাড়ে জনগণের সাথে এখনো সম্পৃক্ত রয়েছেন।
তিনি কমরেড বদরুদ্দীন উমরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়িত জাতি ও জনগণের আন্দোলনে একজন নির্ভরযোগ্য বন্ধু বলে আখ্যায়িত করেন।
ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি মিতু সরকার বর্তমান ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজসহ দেশের সকল শ্রেণী মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করার জন্য আহ্বান জানান।